চট্টগ্রাম, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ , ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভ্যান চালিয়ে দুই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন চীনে

প্রকাশ: ১৬ আগস্ট, ২০২২ ১২:১৩ : অপরাহ্ণ

পীরগঞ্জ ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ- নিজের স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার। অভাবের কারনে নিজে পড়াশোনা করতেন পারেননি মকিম উদ্দীন। কোন মত নাম দস্তকত ছাড়া আর কোন অক্ষর জ্ঞান নেই তার৷ তবে পড়াশোনা করতে না পারার প্রবল আক্ষেপ তাকে তাড়া করে বেড়ায়। নিজের পেশা ভ্যানচালক হলেও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা বদ্ধ ছিল সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন৷ স্বপ্ন যেন এখন বাস্তবতার মুখ দেখছে।নিজের কঠোর পরিশ্রম করে ভ্যান চালিয়ে দুই ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন সূদুর চীন দেশে।
ঠাকুরগাঁওয়ের বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মকিমউদ্দীন। পেশায় তিনি একজন ভ্যানচালক।কর্মজীবনের শুরু থেকে দীর্ঘ ২৮ বছর পা চালিত ভ্যান চালিয়েছেন তিনি। এখন ব্যাটারিচালিত ভ্যানের আয় দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ ও সংসারের ভরণপোষণ করছেন তিনি৷ মাসে যা আয় হয় তা অল্প একটু নিজের জন্য রেখে বাকী সব সন্তানদের পাঠিয়ে দেন।
মকিম উদ্দীনের চার সন্তানদের মধ্যে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অনেক বছর আগে। আর ছোট দুই ছেলে পড়াশোনা করছেন৷  বড় ছেলে হবিবুর রহমান  চীনের জিয়াংসু ইউনিভার্সিটিতে মেকানিক্যাল ডিজাইন এন্ড ম্যানুফ্যাকচার অটোমেশন বিভাগে পড়াশোনা করছেন৷ আর ছোট  আবুল হাসিম একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করছেন। হাজারো কষ্টে সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ায় সমাজে এক আলাদা সম্মানের জায়গা তৈরী হয়েছে মকিম উদ্দীনের পরিবারের পরিবারের৷
প্রতিবেশী নিপু আক্তার বলেন,সম্পর্কে উনারা চাচা-চাচী হয়। কত কষ্ট করে যে তাদের পড়াশোনা করাচ্ছে তা বলার মত নয়৷ আমারো সন্তান আছে। আমি ভাবি তাদের মত পরিশ্রম করে সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারব কি না। তবে তারা আমাদের স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। কষ্ট ও পরিশ্রম করে সব কাজ করা যায়৷ তারই দৃষ্টান্ত চাচার দুই ছেলে।
প্রতিবেশী ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান বাবলু বলেন, প্রকৃতঅর্থে উনারা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। দিনে আনে দিনে খায়। তারা অনেক কষ্ট করে তাদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। অনেক অভাবেও তারা সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ রাখেননি। বিষয়টি আসলে অনুপ্রাণিত হওয়ার মত। আমরা আশা করছি তারা দক্ষ প্রকৌশলী হয়ে এলাকা ও দেশসেবায় নিয়োজিত থাকবেন।
ভ্যানচালক মকিম উদ্দীনের স্ত্রী হুসনেআরা বেগম  বলেন, আমার  দুই মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ে দুটাকে অনেক কষ্ট করে বিয়ে দিছি৷ আর ছেলে দুটাকে পড়াশোনার করানোর ইতিহাস মনে হলে আমার বুকটা ফেটে যায়। মনের অজান্তেই চোখ থেকে কান্না বের হয়৷ কখনো খায়ছি কখনো খায়নি। তবুও সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়েছি৷ পৈতৃক এক বিঘা আবাদি জমি ছিল। ছেলে দুটোর জন্য তা বিক্রি করতে হয়েছে৷  একমাত্র ভ্যানটি আমাদের সম্বল। বাবুর বাবার অনেক বয়স হয়েছে তবুও প্রতিদিন ভ্যান নিয়ে বের হয়। কোনদিন তিনি বসে থাকেননা। আজকে ছেলে দুটা চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করছে। প্রতি মাসে টাকা দেওয়ার লাগে৷ ছেলে দুটাও অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করে। আমাদের যত কষ্টই হোক আমরা তাদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করাতে চায়৷ আপনারা সকলে দোয়া করবেন আমাদের সন্তান দুটোর জন্য।
মকিম উদ্দীন বলেন, আমি ২৮ বছর পা দিয়ে রিক্সা চালিয়েছি৷ এখন ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালাচ্ছি পাঁচ বছর ধরে। ছোটবেলা আমাদের অনেক অভাব থাকায় পড়াশোনা করতে পারিনি। আমাদের সময় যাদের আর্থিক ভালো তারা শুধু পড়াশোনা করতো। তবে আমার ইচ্ছা ছিল আমার সন্তানদের পড়াশোনা করাব। এক বিঘা আবাদি জমি ছিল আমাদের। বড় ছেলে বললো সে চীনে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে পড়াশোনা করবে৷ আমি ভেবেছি ছেলে উচ্চ শিক্ষিত হলে অনেক আবাদি জমি কিনতে পারবে৷ সেজন্য সে জমিটা বিক্রি করে ছেলেকে চীনে পাঠিয়েছি৷ পরে আবার ছোট ছেলেও গেছে। এখন প্রতিমাসে তাদের টাকা পাঠাতে হয়। আমার একমাত্র আয়ের পথ ভ্যান৷ যা হয় তার সবটুকু জমা করে পাঠাই দেয়৷ আমরা স্বামী-স্ত্রী কখনো খায় কখনো না খেয়ে থাকি। কাউকে বলা হয়না এ কষ্টের কথা৷ কোনদিন ভ্যান নিয়ে বাসায় বসে থাকিনা৷ আমি বসে থাকলে টাকা পাঠাব কি করে৷ আমার কষ্ট হোক তবুও তারা ভালো ইন্জিনিয়ার হোক এটাই চাওয়া আমার৷ সকলে আমার সন্তান দুটার জন্য দোয়া করবেন৷
মকিম উদ্দীনের বড় ছেলে হবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন,আমরা এখানে ২০১৯ সালে  ডিপ্লোমা করতে আসি। এখানে পড়াশোনা করতে আসার সময় আমার বাবার যে শেষ জমি টুকু ছিল ৩৩ শতাংশ সেটুকু বিক্রি করে দিতে হয়। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমি আমার বাবা মার সাথে চীনে আসার বিষয়টি অবগত করি । আমার বাবা কোন প্রশ্ন না তুলেই রাজি হয়ে যায়। তাই আমাদের দুই ভাইয়ের  জন্য বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়। এখানে আসার পর আমার বাবা ভ্যান চালিয়ে অনেক কষ্টে আমাদের টাকা পাঠান । আমার বাবা মাঝে মাঝেই আমাকে বলতো বাবা আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে তোমাদের যে কবে কিছু একটা হয়।  আমি আমার বাবাকে সান্তনা দিতাম বাবা আমরা তো দুই ভাই এখানে ভালোমতো পড়াশোনা করি ইনশাল্লাহ খুব শীঘ্রই আপনি একটা সুসংবাদ পাবেন। আমি ও আমার ছোট ভাই পড়াশোনা শেষ করে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে দেশের জন্য কাজ করব। কারণ আমাদের দেশ উন্নত দেশগুলোর থেকে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে। আমরা আমাদের মেধা দেশের জন্য কাজে লাগাতে চায়। আমাদের খুব ইচ্ছা আমরা গবেষণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করব৷
বালীয়াডাঙ্গী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যোবায়ের হোসেন  বলেন, বিষয়টি আসলেই অনুপ্রাণিত হওয়ার মত৷ ভ্যান চালিয়ে তিনি দুই ছেলেকে চীনে পড়াশোনা করান৷ এখান থেকে বুঝা যায় যদি মানুষের ইচ্ছা শক্তি ও পরিশ্রম করার মানসিকতা থাকে তবে সফলতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়৷ এটি আমাদের জন্য আনন্দায়ক বিষয়ক৷ যদি কখনো তার প্রয়োজন হয় সহযোগিতার তবে উপজেলা প্রশাসন তাদের পাশে দাড়াবে৷

Print Friendly and PDF