ইসলামের চোখে সোনা-রুপা
প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর, ২০২৫ ১০:২৫ : পূর্বাহ্ণ
বিশ্বজুড়ে স্বর্ণ-রুপার দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দাম কমলেও গড়ে হিসাব করলে এর দাম ঊর্ধ্বগতি। প্রতিনিয়তই এই দুটি ধাতুর মূল্য হু হু করে বাড়ছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, যুদ্ধ, ডলারনির্ভর ব্যবস্থার অবক্ষয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পরিবর্তন—সব মিলিয়ে সোনা আবারও ‘বাস্তব সম্পদ’-এর প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সংকটের সময় বিশ্বব্যাপী সোনার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। গণমাধ্যমের তথ্য মতে, যখন রাশিয়ার বৈদেশিক সম্পদ পশ্চিমা দেশগুলো জব্দ করে দেয়, তখন অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুঝে যায়—যদি পশ্চিমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে হয়, তাহলে ডলার বা ইউরোয় রাখা রিজার্ভ একদিন জব্দ হতে পারে। কিন্তু সোনা যদি নিজের দেশে থাকে, তাহলে সেটা কেউ জব্দ করতে পারবে না। সে সময় থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা কেনা দ্বিগুণ হয়ে যায়—৫০০ টন থেকে বেড়ে প্রায় ১ হাজার টন হয় প্রতিবছর।
এতে বোঝা যায়, বর্তমান যুগেও সংকট মোকাবেলায় সোনা-রুপাকে আর্থিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ইসলামও সোনাকে কেবল অলঙ্কার নয়, বরং আর্থিক স্থিতিশীলতা ও বিনিময়ের প্রকৃত মানদণ্ড হিসেবে দেখেছে। তাই তো পবিত্র কোরআনে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে যে কারেন্সির উল্লেখ আছে, সেগুলো ছিল সোনা-রুপার তৈরি।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—
‘কিতাবিদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যার কাছে তুমি সম্পদের একটা স্তূপও যদি আমানত রাখ, তবে সে তা তোমাকে ফেরত দেবে। আবার তাদের মধ্যেই এমন লোকও আছে, যার কাছে একটি দিনারও আমানত রাখলে সে তোমাকে তা ফেরত দেবে না যদি না তুমি তার মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকো। তাদের এ কর্মপন্থা এ কারণে যে, তারা বলে থাকে—উম্মিদের (অর্থাৎ অইহুদি আরবদের) ব্যাপারে আমাদের থেকে কোনো কৈফিয়ত নেওয়া হবে না। আর (এভাবে) জেনে শুনে তারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যাচার করে।’
(সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৭৫)
এই আয়াতে যে দিনারের কথা উল্লেখ আছে, তা হলো মূলত স্বর্ণমুদ্রা। আবার সুরা ইউসুফে মহান আল্লাহ বলেছেন—
‘আর তারা (ইউসুফ আ.-এর ভাইয়েরা) তাকে অতি নগণ্য মূল্যে কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল এবং তারা তার ব্যাপারে ছিল অনাগ্রহী।’
(সুরা ইউসুফ, আয়াত : ২০)
এই আয়াতে মহান আল্লাহ দিরহামের কথা উল্লেখ করেছেন, যা মূলত রৌপ্যমুদ্রা। বর্তমানে পৃথিবীতে সরাসরি স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা বিনিময়-মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত না হলেও, এর আবেদন যে শেষ হয়ে যায়নি বা যাবে না—বর্তমান পরিস্থিতি সে দিকেই ইঙ্গিত করছে।
মহান আল্লাহ মানুষের মাঝে সোনা-রুপার প্রতি আকর্ষণ দিয়ে দিয়েছেন। তাই এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ এবং এগুলোর চাহিদা মানুষের স্বভাবজাত বিষয়।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন—
‘মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালোবাসা—নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রুপা, চিহ্নিত ঘোড়া, গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রী। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।’
(সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৭)
সোনা-রুপার প্রতি মানুষের এই আকর্ষণ, আস্থা—এগুলো আর্থিক নিরাপত্তার হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই তো বিশ্লেষকদের অনুমানও সোনার গতি ধরতে পারছে না। অধিকাংশ ব্যাংক এখনো বলছে, সোনার দাম আরও বাড়বে। যেমন ব্যাংক অব আমেরিকা বলছে—আগামী বছরের শেষে দাম পাঁচ হাজার ডলার প্রতি আউন্সে পৌঁছাতে পারে।
তবে এর মানে এই নয় যে, এগুলো অর্জন করতে গিয়ে মহান আল্লাহর বিধি-বিধান ভুলে যাওয়া যাবে। বরং আল্লাহর নির্দেশিত পদ্ধতিতে যদি কেউ সম্পদ অর্জন করে, সঠিকভাবে তার জাকাত আদায় করে এবং মানুষ ও ইসলামের কল্যাণে ব্যয় করে, তবে তা কল্যাণের বিষয়।
আবু বকর ইবনে আবি মারইয়াম (রা.) থেকে বর্ণিত, মিকদাম ইবনে মাদিকারিব (রা.)-এর একটি দাসী ছিল, সে দুধ বিক্রি করত এবং মিকদাম (রা.) তার মূল্য গ্রহণ করতেন। তাঁকে কেউ বলল, সুবহানাল্লাহ! আপনি দুধ বিক্রি করে পয়সা নেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, এতে দোষের কিছু নেই। আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি—
‘লোকদের সম্মুখে এমন যুগ আসবে, যখন (হারাম থেকে বাঁচার জন্য) টাকা-পয়সা ব্যতিরেকে কোনো উপায় থাকবে না।’
(মুসনাদে আহমদ)
সুতরাং হালাল পথে টাকা-পয়সা সঞ্চয়ের গুরুত্ব আছে। তবে অবৈধ উপায়ে সোনা-রুপার সংরক্ষণ, ইসলামের নিয়ম মেনে তার হক আদায় না করা হলে এগুলো ইহকাল-পরকালে বিপদের কারণ হবে।
হাদিসে শরিফে এসেছে—
ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—
‘যে ব্যক্তি স্বীয় সম্পদের জাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তার মাল তার কাছে এক বিষধর সাপরূপে পেশ করা হবে, যার চক্ষুর উপর দুটি কালো দাগ থাকবে। সে সাপ তাকে পেঁচিয়ে ধরবে অথবা গলায় জড়িয়ে ধরবে। সে সাপ বলতে থাকবে—“আমি তোমার ধন-সম্পদ, আমি তোমার ধন-সম্পদ।”’
(নাসায়ি, হাদিস : ২৪৮১)
কিয়ামতের আগে মহান আল্লাহ স্বর্ণের খনিগুলো উন্মুক্ত করে দেবেন, ফলে মানুষের কাছে এত পরিমাণ সম্পদ হয়ে যাবে যে, স্বর্ণ সদকা করার জন্য লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তবে ফোরাত নদীর মধ্যে অবস্থিত স্বর্ণের বিশাল ভাণ্ডার উন্মুক্ত হলে তাকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ যুদ্ধের ইঙ্গিত রয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ইবনে নাওফাল (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন—
আমি উবাই ইবনে কাব (রা.)-এর সাথে দাঁড়ানো অবস্থায় ছিলাম। এমতাবস্থায় তিনি বললেন—বিভিন্ন প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে মানুষ পার্থিব সম্পদ উপার্জনের কাজে সর্বদা নিয়োজিত থাকবে। আমি বললাম, হ্যাঁ, ঠিকই। তখন তিনি বললেন—
আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি—
“অচিরেই ফোরাত তার মধ্যস্থিত স্বর্ণের পাহাড় বের করে দেবে। তা শোনামাত্রই লোকজন সেদিকে চলতে আরম্ভ করবে। সেখানকার লোকেরা বলবে, আমরা যদি লোকদের ছেড়ে দিই তবে তারা সবই নিয়ে চলে যাবে। এ নিয়ে তারা পরস্পর যুদ্ধ জড়িয়ে পড়বে এবং এতে একশ’র মধ্যে ৯৯ জন লোক নিহত হবে।”
(মুসলিম, হাদিস : ৭০১২)
কোনো কোনো বর্ণনায় আছে—মহানবী (সা.) তার উম্মতদের সেই সোনা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন।