প্রকাশ: ২০ অক্টোবর, ২০২৫ ৪:৪৮ : অপরাহ্ণ
সরকারি তেল কোম্পানিতে তেল চুরির ঘটনা মোটামুটি নিয়মিতই ধরা পড়ে, তদন্ত কমিটিও হয়। তবে চুরি থামে না। যমুনা অয়েল কোম্পানির এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহীতে রেল ওয়াগনে রাখা ৫ হাজার লিটার ডিজেল পাচারের সময় কোম্পানির একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন রেলওয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। পাঁচ বছর আগের সেই মামলা এখনো বিচারাধীন।
আট বছর আগে ২০১৭ সালের জুলাইয়ে চাঁদপুরের যমুনার ডিপোতে অবৈধভাবে ৭ লাখ লিটারের বেশি ডিজেল বিক্রির ঘটনায় ডিপো কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। পরের মাসেই এ ঘটনায় প্রতিবেদন দেয় তদন্ত কমিটি। জড়িতদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। তাঁরা এখনো বহিষ্কার রয়েছেন। দুদকেও তদন্ত চলমান আছে। তবে পুরো চক্র শনাক্ত না হওয়ায় চুরি থামছে না।
জ্বালানি তেল আমদানি ও উৎপাদনের কাজটি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বাজারে সেই তেল বিক্রি করে বিপিসির আওতাধীন তিন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। কোম্পানিগুলো তেল বিক্রি থেকে নির্দিষ্ট কমিশন পায়। তেল বিক্রির লাভ বা লোকসানের দায় বিপিসির। তবে নির্দিষ্ট পরিচালন ক্ষতি (অপারেশনাল লস) বাদ দিয়ে তেল বিক্রির হিসাব বুঝিয়ে দিতে হয় কোম্পানিগুলোকে।
মুনা অয়েল কোম্পানির এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহীতে রেল ওয়াগনে রাখা ৫ হাজার লিটার ডিজেল পাচারের সময় কোম্পানির একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন রেলওয়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। পাঁচ বছর আগের সেই মামলা এখনো বিচারাধীন।
দুই ধরনের ক্ষতি হিসাব করার সুযোগ পায় তেল কোম্পানি। একটি রূপান্তরজনিত ক্ষতি। বিষয়টি হলো, যখন তাপমাত্রা বেশি থাকে, তখন তেল পরিমাণে বেড়ে যায়। বিপিসি সূত্র বলছে, তেল কেনার সময় ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তেল পরিমাপ করে নেয় বিপিসি। তবে দেশের ভেতরে তেল সরবরাহের সময় তারা মাপে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়। বিপিসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা উদাহরণ দিয়ে বলেন, তাপমাত্রার এ তারতম্যের কারণে ৩০ হাজার টন তেল বেড়ে ৩০ হাজার ৩০০ টন হয়ে যায়। দেশে শীতের তিন মাস ছাড়া বছরের বাকি সময় তেল বাড়ে। বিজ্ঞানের এই সূত্র চোরদের জানা আছে।
আরেকটি কাজের সময়কার ক্ষতি। দুটি মিলে পরিচালন ক্ষতি হিসেবে শূন্য দশমিক ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পায় তারা। বছর শেষের হিসাবে এর চেয়ে কমই ক্ষতি হয় তেল কোম্পানির। যদিও হিসাবে নানা রকম গরমিল আছে।
বিপিসি সূত্র বলছে, তেল কেনার সময় ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তেল পরিমাপ করে নেয় বিপিসি। তবে দেশের ভেতরে তেল সরবরাহের সময় তারা মাপে ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রায়।
কোম্পানির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা বিপিসির নির্ধারিত পরিচালন ক্ষতির চেয়েও অপচয় কম করছেন। তাহলে চুরি হয় কীভাবে। যদিও কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, কাগজপত্রে ঠিক হিসাব দেখালেও নিয়মিত চলছে তেল চুরির ঘটনা।
তেল চুরি হয় কীভাবে? এর উত্তর খুঁজে বের করতে বিপিসি ও তেল কোম্পানির কর্মকর্তা, জাহাজ, সমুদ্রে তেল খালাসের জেটি, ডিপোর কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলছেন, তেল চুরির একটি বড় উপায় হলো ক্যালিব্রেশন রিপোর্ট বা তেল মজুতের সক্ষমতা জালিয়াতি। ট্যাংক, লরি, জাহাজের তেল ধারণের সক্ষমতা পরীক্ষা করে সনদ দেয় বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। তেল চুরির চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে এই সক্ষমতা কম দেখায়। এতে আসল সক্ষমতা ব্যবহার করে বাড়তি তেল চুরির সুযোগ তৈরি হয়।
ডিপোতে তেল পরিমাপের মধ্যেও আছে চুরির সুযোগ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তেল মাপা হয় সনাতনী প্রক্রিয়ায়, হাতে রড নিয়ে। এর মাধ্যমে ডিপোর ট্যাংক, ট্যাংকলরি ও জাহাজের গভীরতা পরিমাপ করা হয়। এতে মাত্র ১ মিলিমিটার কম দেখালেই ৩০০ থেকে ৫৯০ লিটার পর্যন্ত তেল চুরি করা যায়।
যমুনার খুলনার দৌলতপুর ডিপোতে গত আগস্ট মাসে সক্ষমতা জালিয়াতির একটি ঘটনা ধরা পড়ে। সাড়ে ১৩ হাজার লিটারের একটি লরির সক্ষমতা ৯ হাজার লিটার দেখিয়ে চুক্তি করেছিল যমুনা। পরে ধরা পড়ায় চুক্তি বাতিল করা হয়। এ ছাড়া গত মাসে যমুনার ফতুল্লা ডিপো থেকে পৌনে চার লাখ লিটার ডিজেল গায়েবের ঘটনায় সক্ষমতা জালিয়াতির বিষয়টি সামনে আসে। ইতিমধ্যে ডিপোর দুটি ট্যাংকের সক্ষমতা পুনরায় যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছে যমুনা।
ডিপোতে তেল পরিমাপের মধ্যেও আছে চুরির সুযোগ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তেল মাপা হয় সনাতনী প্রক্রিয়ায়, হাতে রড নিয়ে। এর মাধ্যমে ডিপোর ট্যাংক, ট্যাংকলরি ও জাহাজের গভীরতা পরিমাপ করা হয়। এতে মাত্র ১ মিলিমিটার কম দেখালেই ৩০০ থেকে ৫৯০ লিটার পর্যন্ত তেল চুরি করা যায়।
তাপমাত্রা বাড়লে জ্বালানি তেল বাড়ে, আর কমলে তেলও কমে। এটি বৈজ্ঞানিক সূত্র। এটি কাজে লাগায় তেল চুরির চক্র। দিনের শুরুতে সকালে একবার তেল মাপা হয় ডিপোতে। আবার বিকেলেও একবার তেল মাপা হয়। সকাল ও বিকেলের তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে। সাধারণত সারা দিন রোদের তাপমাত্রায় তেলের পরিমাণ বাড়ে। এই বাড়তি তেলের পুরোটা হিসাবে না দেখিয়ে চুরি করা হয়।
তবে আরও ভয়ংকর হলো ভেজাল মিশিয়ে চুরি করা। বাইরে থেকে কম দামের ভেজাল তেল ডিপোতে নিয়ে এসে পেট্রল ও অকটেনের সঙ্গে মেশানো হয়। ভেজাল তেল নিয়ে অভিযোগ আছে গ্রাহকের। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে পেট্রলপাম্পকে জরিমানা করা হয়। তবে ডিপো থেকে ভেজাল তেলের এ ব্যবসা থামেনি। ডিপোতে অভিযানও হয় না।
ডিপো থেকে সংগ্রহ করা জ্বালানি তেলের মান নিয়ে অভিযোগ জানিয়ে গত ১২ অক্টোবর বিপিসিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলারস, ডিস্ট্রিবিউটরস, এজেন্টস অ্যান্ড পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এতে বলা হয়, তিনটি তেল কোম্পানির মানে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। পেট্রল ও অকটেনের মান খারাপ হওয়ায় মোটরসাইকেল ও গাড়ির ট্যাংকে মরিচা ও জং ধরছে। পাম্পে তেল মজুতের ট্যাংকেও জং ধরছে। সঠিক মাপে তেল দিতে সমস্যা হচ্ছে। তেলের মান ও রঙে পরিবর্তন হচ্ছে। অতীতে কোনো সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। অতিমাত্রায় পাতলা তেলে ‘ডিসপেনসারে’ (যার মাধ্যমে ফিলিং স্টেশন থেকে তেল দেওয়া হয়) সমস্যা হওয়ায় অনেক সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অকটেন সরবরাহ করা যায় না। ডিজেলের মানও অত্যন্ত নিম্ন, যা অতীতে ছিল না।
তাপমাত্রা বাড়লে জ্বালানি তেল বাড়ে, আর কমলে তেলও কমে। এটি বৈজ্ঞানিক সূত্র। এটি কাজে লাগায় তেল চুরির চক্র। দিনের শুরুতে সকালে একবার তেল মাপা হয় ডিপোতে। আবার বিকেলেও একবার তেল মাপা হয়। সকাল ও বিকেলের তাপমাত্রার পার্থক্য থাকে।
এর আগে নিম্নমানের তেল পাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর পদ্মা তেল কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ জ্বালানি তেল পরিবেশক সমিতি। এতে বলা হয়, খুলনার দৌলতপুরে পদ্মার ডিপো থেকে আসা পেট্রল ও অকটেনের গন্ধ তীব্র। মোটরসাইকেল ঠিকমতো ‘মাইলেজ’ (১ লিটার তেল খরচ করে কত কিলোমিটার চলা যায়) পাচ্ছে না।
পেট্রলপাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ সাজ্জাদুল করিম কাবুল প্রথম আলোকে বলেন, বিএসটিআই এসে পেট্রলপাম্পে জরিমানা করে, তারা ডিপোতে যায় না। অথচ ডিপো থেকে পাতলা তেল সরবরাহ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে তেল চুরির বিষয়ে গত মে মাসে একটি গোপন প্রতিবেদন বিপিসিতে পাঠায় জ্বালানি বিভাগ। এতে বলা হয়, বিদেশ থেকে বড় জাহাজে আসা তেল প্রথমে ছোট জাহাজে খালাস করা হয়। এরপর এটি আনা হয় গুপ্তাখালে থাকা তিন তেল কোম্পানির প্রধান ডিপোর টার্মিনালে।
ডিপো থেকে চারটি ধাপে তেল সরবরাহ করা হয়। অধিকাংশই যায় নদীপথে, ছোট ছোট জাহাজে করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় প্রতিটি জাহাজে নির্ধারিত সক্ষমতার চেয়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার লিটার তেল বাড়তি নেওয়ার গোপন জায়গা থাকে। ট্রেনের ওয়াগনে তেল পরিবহনের ক্ষেত্রেও বাড়তি তেল দেওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রতিটি ট্যাংকলরিতে ১৫০ থেকে ২০০ লিটার তেল বাড়তি দিয়ে দেন চক্রের সদস্যরা। এমনকি ড্রামে তেল ভর্তির সময়ও ১৫ থেকে ২০ লিটার বাড়তি দিয়ে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর জাহাজ থেকে তেল চুরি করে পটিয়া, শান্তিরহাট, মইজ্জারটেক, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জসহ স্থানীয় পাইকারি ও খুচরা বাজারে পাচার করা হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীতে সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় তেল চুরি।
ট্রেনের ওয়াগনে তেল পরিবহনের ক্ষেত্রেও বাড়তি তেল দেওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রতিটি ট্যাংকলরিতে ১৫০ থেকে ২০০ লিটার তেল বাড়তি দিয়ে দেন চক্রের সদস্যরা। এমনকি ড্রামে তেল ভর্তির সময়ও ১৫ থেকে ২০ লিটার বাড়তি দিয়ে দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, তেল চুরির বড় দুটি জায়গা হলো চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় তিন তেল কোম্পানির মূল ডিপো এবং নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও গোদনাইলের ডিপো। এ দুটি জায়গায় নজরদারি নিশ্চিত করতে পারলেই চুরি অনেকাংশে কমে যাবে।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল এলাকায় পদ্মা ও মেঘনা তেল কোম্পানির ডিপো। এখানে অনুসন্ধান চালিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন তৈরি করে জ্বালানি বিভাগে পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়, চুরির সঙ্গে জড়িত কিছু ফিলিং স্টেশন। ডিজেল বা পেট্রল কেনার রসিদ দিয়ে গাড়িতে করে অকটেন নিয়ে যায় তারা। পরে কারিগরি ক্ষতি ও তাপমাত্রাজনিত বৃদ্ধির ফলে পাওয়া বাড়তি তেলের সঙ্গে হিসাব মিলিয়ে দেওয়া হয়। স্টেশনমালিকদের আর্থিক সুবিধা দেয় তেল চুরির চক্র। এ ছাড়া ডিপোতে তেলে ভেজাল মিশিয়ে পরিমাণে বাড়ানোর ঘটনাও ঘটে। অনুসন্ধানের সময় একটি ট্যাংকলরিতে ১৮ হাজার লিটার চালানের বিপরীতে ২২ হাজার লিটার সরবরাহের ঘটনা দেখা গেছে। আরেকটি গাড়িতে সাড়ে ১৩ হাজার লিটার তেল দিয়ে চালান দেওয়া হয় ৯ হাজার লিটারের। তেল চুরির কাজে ব্যবহৃত ৪টি ট্যাংকলরি ও ৭টি ফিলিং স্টেশনের নাম দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
তেল চুরির প্রতিবেদন বলছে, পদ্মার ডিপো থেকে ১২৯টি ট্যাংকলরিতে করে বিমানবন্দরে তেল সরবরাহ করা হয়। প্রতিটি গাড়ি দিনে দুটি ট্রিপ দেয়, প্রতি ট্রিপে ২০ লিটার করে কম সরবরাহ করা হয়। এভাবে দিনে ৫ হাজার ১৬০ লিটার তেল চুরি হয়। চুরির এ তেল নির্দিষ্ট ১৭-১৮টি ট্যাংকলরির মাধ্যমে ডিপো থেকে বের করে চক্রে থাকা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করা হয়। এভাবে বছরে ১৫ কোটি টাকার তেল চুরি করা হয় এ ডিপোর জেটফুয়েল থেকে। চালানের চেয়ে বাড়তি তেল নিয়ে এ চুরিতে যুক্ত থাকা ১৪টি ট্যাংকলরির নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। গোদনাইলের মেঘনা ডিপোতে দিনে সরবরাহ করা হয় সাড়ে ১৩ লাখ লিটার, সিস্টেম লস যায় ৪ হাজার ৫০ থেকে ৬ হাজার ৭৫০ লিটার। পদ্মার ডিপো থেকে দিনে সরবরাহ করা হয় গড়ে ২৫ লাখ ৬০ হাজার লিটার। সিস্টেম লস যায় ৭ হাজার ৬৮০ থেকে ১২ হাজার ৮০০ লিটার। দুটি ডিপো মিলে দিনে গড়ে চুরি হয় ১৩ হাজার ৫০০ লিটার। এভাবে বছরে চুরি হয় বর্তমান বাজারদরে ৪৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার তেল। ডিপোর অনেকেই চুরির সঙ্গে জড়িত। এতে নেতৃত্ব দেন সিবিএ নেতা, ডিপো ও পয়েন্ট ইনচার্জ এবং মিটার রিডাররা।
অনুসন্ধানের সময় একটি ট্যাংকলরিতে ১৮ হাজার লিটার চালানের বিপরীতে ২২ হাজার লিটার সরবরাহের ঘটনা দেখা গেছে। আরেকটি গাড়িতে সাড়ে ১৩ হাজার লিটার তেল দিয়ে চালান দেওয়া হয় ৯ হাজার লিটারের। তেল চুরির কাজে ব্যবহৃত ৪টি ট্যাংকলরি ও ৭টি ফিলিং স্টেশনের নাম দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
সারা দেশে তিন কোম্পানি মিলে ৪৭টি ডিপো রয়েছে। গোদনাইলের মতো একই হারে চুরি ধরা হলেও সব মিলে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার তেল চুরি হয়। সুপারিশ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিপো কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের গত ১৫ বছরের সম্পদের হিসাব নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। পুরো তেল সরবরাহ কাঠামোকে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আওতায় আনা গেলে নজরদারি ও চুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, তেল বিপণন প্রক্রিয়া পুরোটা স্বয়ংক্রিয় না হলে অনিয়মগুলো থেকে যাবে। এটি ধাপে ধাপে করা হচ্ছে। ডিপোতে ফ্লো মিটার (মাপার বিশেষ যন্ত্র) বসানো হচ্ছে, এরপর আর গভীরতা মেপে তেল দেওয়া হবে না। ফতুল্লা, গোদনাইলের ডিপো স্বয়ংক্রিয় করা হবে। তেল কম বা বেশি দিতে পারবে না। তেলের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য মেশিন বসানো হচ্ছে। কর্মকর্তাদের বদলি করা হচ্ছে। আগের চেয়ে অনিয়ম কমে এসেছে।
জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়তে থাকায় প্রতিবছর বিক্রি বাড়ার কথা। বিপিসি সূত্র বলছে, আগের বছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বিক্রি বেড়েছে ১৪ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়েছে ১০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উল্টো কমেছে ৮ শতাংশ। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিক্রি বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাস্তবে বাজারে তেল বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি। কম দামের নিম্নমানের তেল মিশিয়ে ভেজাল তেল বিক্রি করায় প্রকৃত হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার তেল ডিপোতে দুর্নীতি ও কর্ণফুলী নদীতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তেল চুরি বন্ধে কিছু নির্দেশনা দিয়ে গত ২৮ আগস্ট তিন কোম্পানিকে চিঠি দিয়েছে বিপিসি। এতে বলা হয়, রড দিয়ে হাতে তেল মাপার পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তেল মাপার ব্যবস্থা করতে হবে। বিপিসি ও তেল কোম্পানির কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করতে হবে। ট্যাংকলরি, জাহাজ ও রেলের ওয়াগনে তেল সরবরাহের সময় নিয়মিত পরিদর্শন করতে হবে। মূল মজুতাগার ও ডিপোতে রাখা তেল নিয়মিত পরীক্ষা করে মান যাচাই করতে হবে। ডিপো থেকে ট্যাংকলরিতে তেল সরবরাহের সময় বিএসটিআই নির্ধারিত সক্ষমতা অনুসারে তেল পরিমাপ নিশ্চিত করতে হবে।
জ্বালানি তেলের হিসাবে প্রচুর ফাঁকি আছে। কাগজে–কলমে হিসাব ঠিক রাখা হয়। যথাযথ নিরীক্ষাও হয় না। তাই চুরির বিস্তারিত জানা যায় না। তাপমাত্রায় জ্বালানি তেল বাড়ে বা কমে। বাড়তি তাপমাত্রায় পাওয়া তেলের টাকাটা পকেটে চলে যায়। সনাতন উপায় তেল মাপার মধ্যেও ফাঁকি আছে। তেল বিপণন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করতে হবে।
এদিকে কিছু সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নে গত ২৯ সেপ্টেম্বর তিন কোম্পানিকে আবার চিঠি দিয়েছে বিপিসি। এতে বলা হয়, ট্যাংকলরির হালানাগাদ সক্ষমতা প্রতিবেদন দেখে তেল দিতে হবে। ভেজাল রোধে আধুনিক ল্যাব স্থাপন করতে হবে। অবৈধ উৎস থেকে তেল সংগ্রহ ও বিক্রি বন্ধে ডিপো থেকে ফিলিং স্টেশনের তেল নেওয়ার তথ্য নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। জ্বালানি তেলের অনিয়ম, ভেজাল ও চুরি বন্ধে চট্টগ্রামের প্রধান স্থাপনাসহ সব ডিপোর কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় আনতে হবে।
এর আগে গত সরকারের সময় জ্বালানি তেলের সব কটি ডিপো স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় আনার উদ্যোগ নিয়েছিল বিপিসি। দরপত্র আহ্বান করা হলেও পরে সেটি থেমে যায়। এখন নতুন করে ধাপে ধাপে বিভিন্ন ডিপো স্বয়ংক্রিয় করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিপিসি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি তেলের হিসাবে প্রচুর ফাঁকি আছে। কাগজে–কলমে হিসাব ঠিক রাখা হয়। যথাযথ নিরীক্ষাও হয় না। তাই চুরির বিস্তারিত জানা যায় না। তাপমাত্রায় জ্বালানি তেল বাড়ে বা কমে। বাড়তি তাপমাত্রায় পাওয়া তেলের টাকাটা পকেটে চলে যায়। সনাতন উপায় তেল মাপার মধ্যেও ফাঁকি আছে। তেল বিপণন প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করতে হবে।