তিনি বলেছেন, ‘এটা (বৈঠক) বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই, যখন প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনে যাবেন সিদ্ধান্ত হয়েছে, তখন থেকেই মোটামুটি একটু আলোচনা হচ্ছিল যে, সেখানে যেহেতু আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয় আছেন একটা সাক্ষাৎ হতে পারে… এই সম্ভাবনা তখন থেকেই শুরু হয়েছিল।’
‘ওনাকে (তারেক রহমান) ফরমালি দাওয়াত করা হয়েছে মিটিংয়ের জন্যে। এই মিটিংয়ের জন্য আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটির পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করছি, এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট কাটাতে পজিটিভ ভূমিকা রাখতে পারে’, যোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।
বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সাথে বিএনপি নেতার এই বৈঠকে আগামী দিনের রাজনীতিতে নতুন মাত্রাও যোগ করতে পারে।
বিএনপি কেন টার্নিং পয়েন্ট মনে করছে?
সম্প্রতি দক্ষিণ সিটিতে ইশরাক হোসেনের মেয়র পদ, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ইস্যুতে সরকার ও বিএনপির টানাপোড়েনের মধ্যেই পরের বছর এপ্রিলে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণায় বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায় বিএনপি।
যে কারণে ঈদের পর আন্দোলনের জন্য অনেকটা মানসিকভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল দলটি। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাই প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় তোলেন।
সরকারের একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, সরকারের আগ্রহের পরই লন্ডন সফরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে রাজি হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
যদিও শুরু থেকে এই বৈঠকের বিষয়ে দোটানায় ছিল বিএনপি। কিন্তু তারপরও এই বৈঠকটিকেই আবার আগামী দিনের রাজনীতির ‘টার্নিং পয়েন্ট’ মনে করছে দলটি।
মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বর্তমানে যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা অবস্থান, তাতে এটা একটা বড় ইভেন্ট। গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। এটার গুরুত্ব অনেক বেশি।’
একই সাথে এই বৈঠকটিকে বড় রাজনৈতিক ঘটনা আখ্যা দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক যে প্রেক্ষাপট, যে অবস্থান এটা (বৈঠকটি) একটা বড় ইভেন্ট। যদি সব কিছু সঠিকভাবে চলে, তাহলে নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ‘জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। ইতোমধ্যে জানেন, পত্র-পত্রিকায় সাংবাদিকদের মধ্যে বহু আলোচনা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলছে। এর মধ্যে এই মিটিংটা হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে এবং অনেক কিছু সহজ হয়ে যেতে পারে, নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি হতে পারে…সম্ভাবনা অনেক।’
‘এখন এটা নির্ভর করবে আমাদের নেতাদের (মুহাম্মদ ইউনূস-তারেক রহমান) ওপর, তারা কীভাবে সেই সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাবেন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান বৈঠকটিকে একটি মাইলফলক মনে করছেন। তারা বলছেন, গত কয়েক মাসে নানা ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে সম্পর্কের তিক্ততা তৈরি হয়েছে সেটি কাটতে পারে এই বৈঠকের মাধ্যমে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মারুফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে আস্থার সংকট চলছে সেটা নিরসন হওয়া দরকার। সেটা দলের চেয়ে দেশের স্বার্থেই বেশি প্রয়োজন।’
এই বিশ্লেষক মনে করছেন, সংকট কাটাতে সরকার প্রধানের সাথে বিএনপির এই বৈঠকটি হতে পারে সেই টার্নিং পয়েন্ট।
নির্বাচনের সময় নিয়ে সংকট কাটবে?
গত কয়েক মাসে ডিসেম্বরের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি।
সর্বশেষ গত মাসে ঢাকায় এক সমাবেশ থেকে তারেক রহমান স্পষ্টভাবেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে।’
বিএনপির এমন অনড় অবস্থানের মধ্যেই গত ৬ জুন কোরবানির ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
সেখানেই তিনি ঘোষণা করেন, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন।
প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণের পর ওই রাতেই স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকে সরকারের এই ঘোষণার কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। সেখানে দলটির পক্ষ থেকে এপ্রিলে নির্বাচনের বিষয়ে দলের আপত্তির কথা জানানো হয়।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন অবস্থানের মধ্যেই লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে বসছেন তারেক রহমান।
প্রশ্ন উঠছে এই বৈঠকের পর কী তাহলে বিএনপি আগামী নির্বাচন নিয়ে তাদের অনড় অবস্থান থেকে সরে আসবে?
বাংলাদেশের কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরে দাবি করা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের এই বৈঠকে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের দাবি করা হতে পারে।
মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, ‘আমরা আশা করছি, বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সরকার এটা বিবেচনা করবেন। সময়টা তো ঠিক না। রোজার মাস, ঈদ শেষ হবে– তার কয়েকদিন পরেই নির্বাচন।’
‘রোজার সময় নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে প্রার্থী ও রাজনৈতিক কর্মীদের দুর্ভোগ হবে। আমি তো এখন থেকেই উদ্বিগ্ন যে আমাকে প্রতিদিনই ইফতার পার্টি করতে হবে। এতে নির্বাচনের ব্যয়টাও দ্বিগুণ হয়ে যাবে। গরমে দিনের বেলায় জনসভায় লোকজন কীভাবে আসবে। রাত্রে গিয়ে মিটিং করতে হবে’, যোগ করেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্যই এই বৈঠকে নির্বাচন প্রশ্নে তৈরি হওয়া সংকট সমাধানের আশাও দেখছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মারুফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু থাকে না। রাজনীতিতে যে কোন সম্ভাবনাই থাকে। এই বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যে সংকট রয়েছে সেটার আপাততভাবে খানিকটা নিরসনও হতে পারে।’
যে কারণে বিশ্লেষকরাও এই বৈঠকটিকেই আগামীর রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণী বলেই মনে করছেন।