চট্টগ্রাম, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ , ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোয়াখালীর যেসব দর্শনীয় স্থান আপনাকে মুগ্ধ করবে

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ১১:১১ : পূর্বাহ্ণ

নিঝুম দ্বীপ

মায়াবী হরিণ, বিশাল কেওড়া বন, আর নরম বালুর মাঝে অপরূপ সুন্দর এক সৈকত নিঝুম দ্বীপ। হাতিয়া উপজেলার অন্তর্গত বঙ্গোপসাগরের কোলে বালুচর বেষ্টিত ছোট্ট সবুজ ভূখণ্ড এটি। অগণিত শ্বাসমূলে ভরা কেওড়া গাছ দেয়াল বানিয়েছে দ্বীপের চারদিকে। সাগরের জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা লীলাভূমি এ দ্বীপে যেন সৃষ্টিকর্তা সব রূপ ঢেলে দিয়েছেন। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা আসেন এখানে ঘুরতে।

এটি দ্বীপ বলে আখ্যায়িত হলেও মূলত এটি একটি ‘চর’। নিঝুম দ্বীপের নাম আগে ছিল ‘চর ওসমান’। নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকরা প্রতিনিয়ত এখানে ভিড় জমান। পর্যটকদের জন্য রয়েছে কয়েকটি রিসোর্ট। সেখানে রয়েছে সাপ্লাই পানি এবং জেনারেটর। খাবারের জন্য রয়েছে স্থানীয় হোটেল।

নিঝুম দ্বীপের মূল আকর্ষণ চিত্রা হরিণ। রয়েছে মহিষ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এছাড়া শীতের সময় বিপুল পরিমাণ অতিথি পাখির মেলা বসে এ দ্বীপটিতে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পুরো জেলার পরিচিতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তাই দ্বীপটির নামে জেলার নামকরণ করা হয়েছে নিঝুম দ্বীপের দেশ নোয়াখালী’।

মুছাপুর ক্লোজার

সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, নিবিড় বন, গ্রামীণ পরিবেশ, পাখির কোলাহল, বন্যপ্রাণী, ফেনী নদীর ওপর নির্মিত ক্লোজার, ২৩ ভেন্ট রেগুলেটর, মৎস্যজীবী মানুষ উচ্ছ্বাস আর নদীর ছল ছল বিশাল জলরাশি নিয়ে এক অন্য রকম আবহ তৈরি করেছে মুছাপুর ক্লোজার। পানির ছলছল শব্দ আর বিশাল আকাশের নিচে অবারিত নির্মল বাতাস আর সবুজ বনানী আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে।নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে বঙ্গোপসাগরের কুল ঘেঁষে ফেনী নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই ক্লোজার। প্রথম দেখাতে মনে হবে সৈকত। কিছুক্ষণ পরে ভুল ভাঙবে। খুঁজে পাবেননদীপাড়ে সাগরের আবহ। দেখতে সমুদ্র সৈকতের মত এই নদীপাড় স্থানীয়দের কাছে ‘মিনি কক্সবাজার হিসেবেও পরিচিত। প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থী এই ক্লোজারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসে।

মুছাপুরে ফেনী নদীর তীরে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এ ক্লোজার। ২০০৯ সাল থেকে কয়েক দফা বাজেট বরাদ্দ দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের চেষ্টায় ক্লোজারটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৯ সালে এখানে বনবিভাগ বনায়ন শুরু করে। ৩২০০.৮২ একর বনবিভাগের জমিজুড়ে রয়েছে বনাঞ্চল।

 এখানকার বাগানে ঝাউ, কেওড়া, পিটালি, খেজুর, লতাবল, গেওয়া, শনবলই, বাবুলনাটাই, আকাশমনিসহ বিভিন্ন ছোট প্রজাতির গাছও রয়েছে। রয়েছে শিয়াল, বন বিড়াল, সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী।  শীতের মৌসুমে সাইবেরিয়া থেকে আসা অতিথি পাখিদেরও দেখা যায় এখানে। বনের সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটু ভেতরে প্রবেশ করলে পাওয়া যায় শীতল ছায়া ও কোথাও কোথাও বিশাল খোলা জায়গা। তার পাশেই দেখা যায় দিগন্তজোড়া সৈকতের অপার মাধুর্য। 
 
এখানে চারপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন রকমের বনজ গাছ। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কোলাহল, বিশাল সমুদ্র সৈকত। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্যের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। রয়েছে ট্রলারে কিংবা স্পিডবোটে করে চরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ।

কমলার দীঘি

হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডের মানুষ ঘুরাঘুরি বা অবসর সময় কাটানোর জন্য সবচেয়ে বেশি যে জায়গাটি ভ্রমণ করেন, তা হলো কাজির বাজার এলাকার কমলার দীঘি। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ জায়গাটির এক পাশে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন, আরেক পাশে রয়েছে ঝাউবন, সুবিশাল মাঠ, বনভূমি এবং অন্য পাশে রয়েছে সুবিশাল সমুদ্র।

No description available.
কমলার দিঘীর একপাশে রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন, আরেক পাশে রয়েছে ঝাউবন। ছবি: সংগৃহীত

জোয়ারের সময় এখন থেকে উপভোগ করা যাবে সমুদ্রের গর্জন, আর ভাটার সময় বিস্তীর্ণ বালিরাশি ও সমুদ্রের সৌন্দর্য। তাছাড়া এখান থেকে সমুদ্র চলমান শত শত জাহাজের সারি দেখা যায়। সূর্যাস্তের সময় কমলার দীঘির চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শরীর ও মন জুড়ানো শীতল বাতাসের কারণে প্রতিদিন এখানে এ এলাকার লোকজনের ভিড় জমে।


শীতকালে প্রায় প্রতিদিন এখানে হাতিয়ার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সংগঠন ও পরিবারের লোকজন পিকনিক করতে আসে। তাছাড়া বছরের যে কোন সময় এ জায়গাটিতে ভ্রমণ করা যায় এবং এর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ওসখালী বাজার থেকে মোটরসাইকেল বা সিএনজি যোগে মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মধ্যেই কমলার দীঘিতে পোঁছানো যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই বিচ সংলগ্ন বাগানগুলোতে শিয়ালের হাঁকডাক সৃষ্টি  করে সুমিষ্ট সুরের লহরি।

কেশারপাড় দীঘি

সেনবাগ উপজেলাধীন ২নং কেশারপাড় ইউনিয়নে অবস্থিত কেশারপাড় দীঘি। বর্তমানে এ দীঘির মোট আয়তন ২৫ একর। এ দিঘীর নামে কেশারপাড় গ্রামটির নামকরণ করা হয়। যদিও এর সঠিক উৎপত্তির সময়টা এখনো অজানা।


No description available.
প্রতি বছর কেশারপাড় দীঘিতে ছিপ দিয়ে মৎস্য শিকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বলা হয়ে থাকে যে, লাকসাম-দৌলতগঞ্জের জমিদার আউয়ুব আলী চৌধুরী ও কল্যান্দী হেম বাবু — এ দুই জমিদারের অধীনে এ দীঘি ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ছিল অনাবাদি জমি। ১৯৩৮ সালে এ দীঘির মাটি কেটে পরিষ্কার করে মাছ চাষ শুরু করা হয়।

 
২০০০ সালের পর থেকে প্রতি বছর এ ঐতিহাসিক দীঘিতে ছিপ দিয়ে মৎস্য শিকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এ প্রতিযোগিতা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অংশ নিতে আসা শৌখিন মৎস্য শিকারিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। এ মৎস্য শিকারকে কেন্দ্র করে দীঘির চারপাশে মেলার আয়োজন হয় এবং উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। নোয়াখালী সদর থেকে উত্তরে ২৫ কিলোমিটার এবং সেনবাগ থেকে ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এ কেশারপাড় ইউনিয়ন।

গান্ধী আশ্রম

গান্ধী আশ্রম নোয়াখালী জেলার মাইজদী কোর্ট থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সোনামুড়ী উপজেলার জয়াগ বাজারের কাছে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রয়াত জমিদার ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষের বাড়িতে স্থাপিত গান্ধী আশ্রম নোয়াখালীর একটি সেবামূলক সংগঠন হিসেবে সারা দেশব্যাপী সুনাম অর্জন করেছে।

No description available.
গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত

মহাত্মা গান্ধীর অহিংস সমাজ ব্যবস্থার ধারণাকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে ২০০০ সালের ২ অক্টোবর গান্ধী আশ্রমের মূল ভবনে গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর যাত্রা শুরু করে। গান্ধীর বিভিন্ন দুর্লভ ছবি, বই, ব্যবহার্য জিনিস এবং তার বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন যে কারো মনোজগৎ নাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।  প্রতি সপ্তাহের সোম থেকে শনিবার গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

বজরা শাহী মসজিদ

নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নে নির্মিত ঐতিহাসিক মসজিদের নাম বজরা শাহী মসজিদ। দিল্লির শাহী জামে মসজিদের নকশার অনুকরণে বজরা শাহী মসজিদটি গড়ে তোলা হয়েছে।

  

No description available.
বজরা শাহী জামে মসজিদ। ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৭৪১-৪২ সালে জমিদার আমানুল্লাহ ৩০ একরের ভূমিতে একটি বিশাল দীঘি খনন করেন এবং দীঘির পশ্চিম প্রান্তে একটি আকর্ষণীয় মসজিদ নির্মাণ করেন। সুন্দর প্রবেশ তোরণ বিশিষ্ট বজরা শাহী মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৬ ফুট, প্রস্থ প্রায় ৭৪ ফুট এবং মসজিদটির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির ভীত মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচ থেকে তৈরি করা হয়েছে। তিনটি গম্বুজই সুদৃশ্য মার্বেল পাথর সুসজ্জিত। মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য ৩টি ধনুকাকৃতি দরজা এবং কেবলার দিকে ৩টি কারুকার্য খচিত মিহরাব রয়েছে। মসজিদের প্রবেশ পথের তোরণের ওপর আরো কয়েকটি গম্বুজ প্রত্যক্ষ করা যায়। ঐতিহ্যবাহী বজরা শাহী মসজিদটি নির্মাণের প্রায় ১৭৭ বছর পর ১৯০৯ সালে প্রথমবার সংস্কার করা হয়।


লোকমুখে প্রচলিত আছে, বজরা শাহী মসজিদে কোনো কিছু মানত করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তাই দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে বজরা শাহী মসজিদে নামাজ আদায় এবং দুরারোগ্য ব্যাধি হতে মুক্তি পাওয়ার আশায় মসজিদে টাকা-পয়সা ও শিরনি দিতেন। ১৯৯৮ সালে ২৯ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ঐতিহাসিক বজরা শাহী মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষা এবং দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সুত্র-সময়

Print Friendly and PDF