চট্টগ্রাম, শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ড্রাগন ফলে ব্যবহার হচ্ছে ‘টনিক’, চেনার উপায় ও স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনে নিন

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১১:৩৯ : পূর্বাহ্ণ

 

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ড্রাগন ফল। এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে এটি। ইতোমধ্যে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা চারটি প্রজাতি উদ্ভাবন করেছে। সেগুলো হচ্ছে বারি-১, বাউ ড্রাগন-১, বাউ ড্রাগন-২ এবং বাউ ড্রাগন-৩। প্রথমটি উদ্ভাবন করেছে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট। আর বাকি তিনটি করেছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ও জার্মপ্লাজম সেন্টার।

দেশীয়ভাবে উৎপাদন বাড়ার কারণে দামও কমে এসেছে বিদেশি ফলটির। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘টনিক’ ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন এবং এর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, এসব ফল থেকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দিতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ড্রাগন চাষে কি আসলেই ‘টনিক’ ব্যবহৃত হচ্ছে? আর হলে এসব ফল খেলে স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা কতটুকু?

‘টনিকের’ ব্যবহার 

নাটোর ড্রাগন ফ্রুটসের পরিচালক মনিরুজ্জামান মুন্না বছরে প্রায় ৫০-৬০ টনের মতো এই ফল উৎপাদন করেন। ১০ বছর আগে ২০১৪ সালে ইউটিউব দেখে গাছের চারা সংগ্রহ করে বাগান গড়ে তোলেন তিনি। মুন্না বলেন, একবার ড্রাগনের বাগান করলে এবং সেটি সঠিকভাবে চাষাবাদ করলে প্রায় এক শতাব্দী ধরে ফল পাওয়া সম্ভব। পুরাতন ডাল কেটে দিলে সেটির ওপর দিয়ে নতুন বের হয়। এভাবে রি-শাফল করে গাছ যতদিন ইচ্ছা, ততদিন রাখা যায়। জুনের পর থেকে বছরের বাকি সময় ড্রাগনের বেশ ভালো দাম পাওয়া যায়।

 

টনিক ব্যবহার করে ফল চাষ করেন এমন কয়েকজন চাষির সঙ্গে পরিচয় রয়েছে মুন্নার। তাদের সঙ্গে আলাপ করেই নিজের বাগানে তা ব্যবহার করেন না তিনি। কারণ হিসেবে নাটোর ড্রাগন ফ্রুটসের পরিচালক বলেন, যে চাষিরা ব্যবহার করেছেন, তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, এটি প্রয়োগ করলে প্রথমে এক-দুই বছর ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে পরে কমে আসে। এছাড়া গাছও দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সার ও খাবার বেশি দিতে হয়।

 

একই সঙ্গে বড় ড্রাগনের তুলনায় ছোট ফলে ভালো দাম পাওয়া যায় বলে জানান মুন্না। তিনি বলেন, এই টনিক সম্ভবত ভারত থেকে আসে। চুয়াডাঙ্গা, কালীগঞ্জের দিকে এটি বেশি ব্যবহার হয়।

কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের ফল বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. উবায়দুল্লাহ কায়ছার বলেন, সম্প্রতি ড্রাগন চাষে টনিক ব্যবহারের বিষয়টি জানতে পেরেছি আমরা। সীমান্ত এলাকার কিছু কৃষক এটি ব্যবহার করছেন। এরই মধ্যে এসব ড্রাগন এবং যে টনিক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর নমুনা সংগ্রহ করেছি। এগুলোর রাসায়নিক পরীক্ষা করে দেখা হবে।

 

টনিক কী? 

ড. কায়ছার বলেন, টনিকটা হচ্ছে এক ধরনের হরমোন। এটা গাছে ব্যবহার করলে বৃদ্ধি বেশি ও দ্রুত হয়। এই পদ্ধতির ব্যবহার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট উৎসাহিত করে না। এটা আমাদের গবেষণার রিকমেন্ডেড না। বাইরে থেকে একটা হরমোন আসছে। যেটা আমাদের সরকারিভাবেও অনুমোদিত নয়।

বাউ ড্রাগন প্রজাতিটি উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক ড. মো. মোক্তার হোসেন বলেন, গাছ ও ফলের বৃদ্ধি তরান্বিত করতে বিভিন্ন ধরনের হরমোন রয়েছে। ড্রাগন উৎপাদনের জন্য যে টনিক ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটির নাম জিএ৩ বা জিবারেলিক এসিড থ্রি। তবে এটি টনিক নামেই ভারত থেকে দেশে আসছে।

 

তিনি বলেন, এটি মূলত গ্রোথ হরমোন। তবে টনিক হিসেবে যেটি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিতে হরমোন ছাড়া আরও কিছু উপাদান মিশ্রিত করা হয়। এগুলো খুব র‌্যাপিড এক্সপ্যানশন করে ফ্রুটসের। অনেক বাগানেই এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। বাউবি থেকে যেসব কৃষককে চারা দেয়া হয়, তাদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতেই ড্রাগন উৎপাদনের পরামর্শ দেয়া হয়।

 

ড. মোক্তার বলেন, আমরা সেসব কৃষককে বলি ন্যাচারাল প্রোডাকশনে থাকলেই ড্রাগনের ফিউচারটা ব্রাইট হবে। আর কোনও কারণে কেমিকেল ইউজ করলে কাস্টমাররা এই ফল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। ফলে তখন বেশি প্রোডাকশন করেও পারবেন না। দেশে শুধু ড্রাগন নয় বরং মূলা উৎপাদনেও এই টনিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে মূলার উৎপাদনের সময় অন্তত ২০ দিনের মতো এগিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। সবজিটি উৎপাদনে সাধারণত ৬০-৬৫ দিন লাগে।

 

টনিক ব্যবহৃত ড্রাগন চেনার উপায়

অধ্যাপক ড. মোক্তার বলেন, টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন দেখে চেনার কিছু উপায় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- সাধারণ ও প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ফলের ওজন আড়াইশ থেকে সর্বোচ্চ ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। আর টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগনের ওজন ৩০০ থেকে ৯০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ফলের বাহ্যিক আকার উদ্ভট হয়। রং পার্পেল বা লাল হয় না। সহজ করে বললে, ফলটি এক রঙা থাকে না।

 

তিনি বলেন, পার্পেল বা লালের সঙ্গে সবুজ রঙের মিশ্রণ থাকে। এক পাশে বা অন্তত এক তৃতীয়াংশ সবুজ থাকে। কারণ পুরো এক রঙের হওয়া পর্যন্ত গাছে রাখা হলে সেটি পচে যায়। একইসঙ্গে চার-পাঁচদিনের মধ্যে বিক্রি না হলে, পুরোটাই হলুদ হয়ে যাবে। টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ড্রাগন হবে পানসে। মিষ্টি একেবারেই হবে না। এছাড়া স্বাদেও বেশ ভিন্ন হবে। টনিক ব্যবহার করলে গ্রোথ (ফলের বৃদ্ধি) র‌্যাপিডলি(দ্রুত) হয়। বাহ্যিক আকারও স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন হয়। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান তৈরি হওয়ার পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায় না। এর আগেই সেগুলো তুলে বিক্রি করতে বাধ্য হতে হয়। কারণ সেগুলো বেশি দিন থাকলে ওয়েট (ওজন) অনেক বেড়ে যায়।

 

স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটা? 

ড. মোক্তার বলেন, কৃত্রিমভাবে উৎপাদিত যেকোনও পণ্যেরই স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বিভিন্ন রাসায়নিক নিরাপদ উপায়ে ব্যবহারের মাত্রা ঠিক করে দেয়। কিন্তু দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটা মানা হয় না। বেশি পরিমাণে হরমোন বা রাসায়নিক ব্যবহার করলে তা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তবে এই হরমোন ব্যবহারের কোনও সহনীয় মাত্রা আছে কিনা-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হরমোন ব্যবহারেরই কোনও অনুমোদন দেশে নেই।

ড. কায়ছার বলেন, এই টনিক ব্যবহার করে উৎপাদিত ফলের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এই হরমোন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। মূলত এ কারণেই এটি পরীক্ষা করে দেখার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা।

 

 

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অবলম্বনে তৈরি

Print Friendly and PDF