চট্টগ্রাম, বৃহস্পতিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মিথ্যা ও হয়রানি : ক্ষতিপূরণ দিতে আইন করার পরামর্শ হাইকোর্টের

প্রকাশ: ১৭ জুলাই, ২০২৩ ১২:৪৭ : অপরাহ্ণ

বিচারক, আইনজীবী এবং বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের ‘ন্যাশনাল জুডিসিয়াল একাডেমির’ আদলে ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের পর বিচারকদের দায়িত্ব প্রদান এবং মিথ্যা, হয়রানিমূলক মামলায় ক্ষতিগ্রস্থকে ক্ষতিপূরণ দিতে আইন প্রণয়নের পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

মো. জালাল উদ্দিন মিয়া ও অন্যান্য বনাম আলহাজ আবদুল আওয়াল ও অন্যান্য মামলার রায়ে এমন পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এক সিভিল রিভিশনের ওপর জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া ওই রায়ের ৩১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।

রায়ে অধঃস্তন সকল আদালতের সেরেস্তাদারগণকে Civil Rule and Order এর ধারা ৫৫ অক্ষরে অক্ষরে পালনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এবং সেরেস্তাদারগণ তা সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা সেটি সংশ্লিষ্ট সকল সেরেস্তাদারগণের নিয়ন্ত্রনকারী বিচারকদের দেখভাল করতে বলা হয়েছে।

পাশাপাশি দেওয়ানী মামলা পরিচালনার জন্য ব্যবহারিক নির্দেশাবলীর ম্যানুয়াল (Manual of Practical Instructions for the Conduct of the Civil Cases) অনুযায়ী সকল দেওয়ানী আদালতের বিচারকদের বিচারকার্য পরিচালনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

অত্র রায় ও আদেশের অনুলিপি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে পাঠনোর জন্য রেজিষ্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। অবগতি ও পর্যালোচনার জন্য অত্র রায় ও আদেশের অনুলিপি অধস্তন আদালতের সকল বিচারককে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠনোর জন্য রেজিষ্ট্রার জেনারেলের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়।

একই সঙ্গে অত্র রায় ও আদেশের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ দেশের সকল আইনজীবী সমিতিতে ইমেইলের মাধ্যমে পাঠাতে বলা হয়। এ ছাড়া অত্র রায় ও আদেশের অনুলিপি বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পাঠাতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি রায়ের অনুলিপিসহ নথি সংশ্লিষ্ট আদালতের দ্রুত প্রেরণের নির্দেশ দেন।

 

 

হাইকোর্ট এই রায়ে ১৫ দফা পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হলো :

১। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, বিজ্ঞ আইনজীবী, সরকারী আইন কর্মকর্তা এবং বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের জন্য ‘ন্যাশনাল জুডিসিয়াল একাডেমি, ভারত’ এর আদলে সুবিধাজনক নিরিবিলি পরিবেশে এক হাজার হেক্টর জায়গার উপর ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করা।

২। বিচারকগণের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স ছয় (০৬) মাসে উন্নীত করা এবং উক্ত প্রশিক্ষণকালে তাদের মনোজাগতিক বিকাশের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৩। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনে প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের সময় আবশ্যিকভাবে একজন মনোবিজ্ঞানীকে ভাইবা বোর্ডে সদস্য রাখা।

৪। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পরই নবনিযুক্ত বিচারকগণের বিচারিক দায়িত্ব প্রদান করা।

৫। সকল পর্যায়ের বিচারকগণকে প্রতি বছর অন্তত দুইবার পনের (১৫) দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৬। বিচারকগণের দেশের বাইরে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সেক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় জুডিসিয়াল ট্রেনিং সেন্টার/ইন্সটিটিউট/একাডেমির সঙ্গে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক (MOU) স্বাক্ষর করা।

৭। দেওয়ানী কার্যবিধি, Civil Rules and Orders এবং Manual of Practical Instructions for the Conduct of the Civil
Cases এর ব্যাপক সংশোধন যুগোপযোগীকরণ এবং উন্নতকরণ করা।

৮। যুক্তরাজ্যের আদলে মিথ্যা, হয়রানিমূলক, অযৌক্তিক ও হেতুবিহীন দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষকে যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ/খরচ প্রদান সংক্রান্ত আইন ও বিধি প্রণয়ন করা।

৯। দেওয়ানী বিচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত সেরেস্তাদার পদটিকে নন-গেজেটেড প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করা। উক্ত পদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিচার বিভাগীয় সহায়ক কর্মচারীদের পদ-পদবির পরিবর্তন করা।

১০। এফিডেভিটের মাধ্যমে সিভিল মামলায় (ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল এর মতো) জবানবন্দী গ্রহনের বিধান করা।

১১। দেওয়ানী মামলার আপোষ নিষ্পত্তি এবং জারি মামলার ক্ষেত্রে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারকে আরও সম্পৃক্ত করা এবং তার এখতিয়ার, ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তৎমতে আইন ও বিধি সংশোধন করা।

১২। প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়োগ এবং বিচারকের নিরাপত্তার ব্যবস্থাসহ পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট বৃদ্ধি করা।

১৩। Online Filing এবং Online Cause list এর মাধ্যমে মামলা ব্যবস্থাপনা করা।

 

১৪। একজন আইনজীবী তথা এ্যাডভোকেট আদালতের অফিসার। দেশ ও সমাজের প্রতি এ্যাডভোকেটগণের কর্তব্য এবং দায়বদ্ধতা অপরিসীম। কোন অবস্থাতেই মিথ্যা, আইনগত অধিকারবিহীন, অযৌক্তিক ও অন্যকে হয়রানীমূলক মোকদ্দমা দায়েরে সহযোগিতা না করা। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনজীবীদের দেশ ও সমাজের প্রতি উপরোল্লিখিত কর্তব্য সম্পর্কে গুরুত্ব প্রদান করে তাদের প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতামুলক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এর আয়োজন করলে মামলা জট অনেকাংশে কমে যেতে বাধ্য। আশা করি বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

 

১৫। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ বাংলাদেশের সকল আইনজীবী সমিতিসমূহ এ ব্যাপারে সভা ও সেমিনার আয়োজন করে বেআইনি ও আইনগত অধিকারবিহীন অহেতুক মিথ্যা হয়রানিমূলক মোকদ্দমা পরিহার করতে স্ব-স্ব সমিতির আইনজীবীদের সচেতন করলে দেশ ও সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমনটি পালিত হবে তেমনি প্রয়োজনীয় বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিচারিক সময় ব্যয় করা যাবে এবং মামলাজট হ্রাস পাবে।

পরামর্শসমূহ দ্রুত কার্যকর করলে আমরা আমাদের বিচার ব্যবস্থার এই ভয়াবহ মামলাজট থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসতে পারবো। আশা করি আইন মন্ত্রণালয় এই ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনগনের বিচার পাওয়ার পথ সুগম করবেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, মামলার ১নং বিবাদী নির্বাহী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বি.উ.বো) কুষ্টিয়া কর্তৃক স্বাক্ষরিত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কুষ্টিয়া বরাবর বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন হস্তান্তর সম্পর্কিত সারক নং- তঃ প্রঃ কুঃ/পওস/প্র- ২৯/২০০৩/৮৯৬ তারিখ ২৯.০৫.২০০৩ বেআইনি, যোগাযোগী এবং বাদীর উপর বাধ্যকর নয় মর্মে ঘোষণার ডিক্রি চেয়ে বাদী (আলহাজ আবদুল আওয়াল ও অন্যান্য) দেওয়ানী (মোকদ্দমা নং- ১৭৪/২০০৩) মামলা দায়ের করেন।

মামলার শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ২২ জুন কুষ্টিয়ার সিনিয়র সহকারী জজ, (সদর, কুষ্টিয়া) শেখ আবু তাহের কুষ্টিয়ার চাল কলের (Rice Mill) মালিক এবং স্থানীয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গ্রাহক আলহাজ আবদুল আওয়াল ও অন্যান্যদের আর্জি প্রত্যাখ্যান করেন এবং অস্থায়ী ও অন্তবর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার দরখাস্তও সরাসরি নামঞ্জুর করেন।

 

 

এরপর উপরিল্লিখিত রায় ও আদেশে সংক্ষুদ্ধ হয়ে বাদীপক্ষ (আবদুল আওয়াল ও অন্যান্য) কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন।

পরে আপিল আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৫ সালের ১৬ আগস্ট কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ১ম আদালত এর বিচারক মো. ফজলুর রহমান সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মঞ্জুর করেন।

পরবর্তীতে উপরিল্লিখিত রায় ও ডিক্রিতে সংক্ষুদ্ধ হয়ে বিবাদীপক্ষ (নিম্ন আদালতের বিবাদী পক্ষরা) কুষ্টিয়ার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং অন্যদের মধ্যে মো. জালাল উদ্দিন মিয়া ও অন্যরা হাইকোর্টে সিভিল রিভিশন দায়ের করেন।

ওই বিষয়ে ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করেন আদালত।

হাইকোর্টে আপিল আবেদনকারী জালাল উদ্দিনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। আর বিবাদীপক্ষে (নিম্ন আদালতে বাদী) কোন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না।

 

 

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, এটি স্বীকৃত যে, আমাদের বিচার বিভাগ ভয়াবহ মামলাজটে ন্যুজ প্রায়। প্রতিদিনই এ মামলাজট ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর থেকে উত্তোরণের উপায় খুঁজতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ কার্যত দিশেহারা। একজন সৎ, দক্ষ, কর্মঠ, দেশপ্রেমিক এবং সক্রিয় বিচারক আইনগত অধিকারবিহীন অযৌক্তিক, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মোকদ্দমা শুরুতেই ছুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম।

অত্র মোকদ্দমায় আইনগত অধিকারবিহীন তথা আইন দ্বারা বারিত অত্র মোকদ্দমাটি মূলত শুরুতেই ছুড়ে ফেলে দিয়ে কুষ্টিয়া সিনিয়র সহকারী জজ, (কুষ্টিয়া সদর) শেখ আবু তাহের দেওয়ানী কার্যবিধির Order 7 Rule 11 (a) এবং (d) অনুযায়ী যেমনিভাবে তার উপর প্রদত্ত আইনগত দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে প্রতিপালন করেছেন তেমনিভাবে মামলাজট কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

 

 

অপরদিকে কুষ্টিয়া অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ১ম আদালতের, (আপিল আদালত) বিজ্ঞ বিচারক মো. ফজলুর রহমান আইনের ভুল ব্যাখ্যা করে আপিলটি মঞ্জুর করেছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেছেন, একজন দক্ষ বিচারক তৈরি করতে হলে প্রথমেই তাকে দীর্ঘমেয়াদী বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করতে হবে এবং উপরোক্তভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরির পরেই একজন বিচারককে বিচারকার্য পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। তবেই অযৌক্তিক, বেআইনি ও হয়রানিমূলক মোকদ্দমা থেকে বিচার বিভাগ যেমনটি মুক্ত হবে তেমনি মামলা জটও কমে যাবে।

 

 

সূত্র – চ্যানেল২৪

Print Friendly and PDF