চট্টগ্রাম, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪ , ২৫শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পুতিনের সঙ্গে সৌদি আরবের বন্ধুত্ব পশ্চিমাদের জন্য ওয়েক-আপ কল

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর, ২০২২ ১১:২৩ : পূর্বাহ্ণ

প্রতিটি ছবি একটি গল্প বলে। ২০১৮ সালের জুনে মস্কোতে পুরুষ ফুটবল বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হাস্যোজ্জ্বল করমর্দনের ছবিও স্পষ্ট সতর্কবার্তা বহন করে। পশ্চিমা বিশ্বের জন্য যেটা ওয়েক-আপ কল বলে দ্য গার্ডিয়ানে লেখা এক কলামে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিখ্যাত কলামিস্ট সিমন টিসডাল।

সাম্রাজ্যবাদের সময়কালে ব্রিটিশদের ছায়াতলে ছিল সৌদি আরব। পরে ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে সৌদিকে মদদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যে কারণে ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে সৌদির ঘনিষ্ঠ সংযোগকেও আমলে নেয়া হয়নি। তবে সেসব ছিল কালের পরিক্রমায় মুসলিম প্রধান দেশটির কৌশল মাত্র। মূলত সেসময় থেকেই নতুন বন্ধু তৈরি করতে মনোযোগ দেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।

ইতোমধ্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করে সৌদির অর্থনীতি ফুলেফেঁপে ওঠে। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে তারা। ইয়েমেন ও লেবাননে আঞ্চলিক বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করে দেশটি। পাশাপাশি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। একইসঙ্গে পশ্চিমা মানবাধিকারের উদ্বেগ খারিজ করে দেয় সৌদি। সেই সঙ্গে নিজস্ব পথে চলতে থাকে তারা।

সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মদ বিন সালমানের বয়স মাত্র ৩৭। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ৫০ বছর দেশটি শাসন করবেন তিনি। বর্তমানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ সৌদি যুবরাজ। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অধীনে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। একই বছরের শুরুতে স্যালিসবারির বিষক্রিয়া এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরে ও বিদেশে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, সমালোচক এবং সাংবাদিকদের ওপর প্রাণঘাতী হামলার জন্য তাকে ব্যাপকভাবে দায়ী করা হয়। এতে মোহাম্মদ বিন সালমানের মৌন সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হয়।

এর ৪ বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে ইস্তাম্বুলে ভিন্নমতের সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড ঘটে। এতে পুতিন ও মোহাম্মদ বিন সালমানের ইন্ধন ছিল বলে গুঞ্জন রটে। যার তীব্র নিন্দা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদির কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেন। দেশটির যুবরাজকে জড়িয়ে গোয়েন্দা তথ্য প্রকাশ করেন।

মূলত তখন থেকেই মার্কিন-সৌদি সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয়। তা সত্ত্বেও চলতি বছরের জুলাইয়ে রিয়াদ সফর করেন ইউএস প্রেসিডেন্ট বাইডেন। নেপথ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল তার। প্রথমত, তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো এবং তাদের মিত্রদের জোট ওপেক প্লাসকে উৎপাদন বাড়াতে সৌদিকে অনুরোধ করেন তিনি। যাতে বিশ্বে তথা যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি পণ্যটির দাম না বাড়ে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যে তেল বিক্রি করে ইউক্রেন যুদ্ধে যেন অর্থ জোগাতে না পারে রাশিয়া।

দ্বিতীয়ত, এ সফরে মোহাম্মদ বিন সালমানকে বাইডেন বোঝাতে চেয়েছিলেন, মধ্যপ্রাচ্য এখনও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। সেজন্য ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সৌদি যুবরাজকে আহ্বান জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এছাড়া ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট শক্তিশালী করতে তাকে উৎসাহিত করেন বাইডেন।

তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মূল্য উদ্দেশ্য ছিল তেলের উত্তোলন বাড়ানো এবং মার্কিন মুলুকে জ্বালানির দাম সহনশীল রাখা। যাতে আগামী মাসে মধ্যবর্তী কংগ্রেসের নির্বাচনে তার দল ডেমোক্র্যাট জয়লাভ করতে পারে। একইসঙ্গে নিজের বুদ্ধিমত্তাও প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সব আশায় গুড়েবালি হয়। সেসময় দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় ওপেক প্লাস। সৌদি ও রাশিয়া নেতৃত্বাধীন জোটটির এই সিদ্ধান্তে একরকম আকাশ ভেঙে পড়ে হোয়াইট হাউসের ওপর। বিশেষ করে ইউএস প্রেসিডেন্টের গালে যেন কষে চড় মারে ওপেক প্লাস। তার জন্য যা চরম লজ্জাকর।

স্বাভাবিকভাবেই এতে জয় ঘটে প্রেসিডেন্ট পুতিনের। যদিও উত্তোলন কমানোয় বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য খুব বেশি বাড়বে না। তবে তাতে স্পষ্ট যুক্তরাষ্ট্র ও জ্বালানি-ক্ষুধার্ত ইউরোপের বিরুদ্ধে রয়েছে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো। আর রাশিয়ানদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে তারা। একে পশ্চিমা মহলের জন্য ওয়েক-আপ কল বলা হচ্ছে। অবশ্য সৌদি বলছে, অর্থনৈতিক বিচেনায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই।

Print Friendly and PDF