প্রকাশ: ১১ অক্টোবর, ২০২২ ১০:৫৬ : পূর্বাহ্ণ
স্বামীর সঙ্গে বদেশ্বরীর মহালয়ায় যাওয়ার বায়না ধরেছিল স্ত্রী শান্তি রানী। কিন্তু তাকে যেতে দেননি স্বামী। স্বামীর অনুশাসন মানতে গিয়ে তাৎক্ষণিক মনের মধ্যে সুপ্ত অভিমান জমাট বেঁধেছিল। কিন্তু প্রোক্ষণেই তা মুছে যায় মন থেকে। কারণ আদরের দুই মেয়ে এবং তাদের দুই জামাই, ছোট ছেলের শ্বশুর এবং আরও একজন নিকট আত্মীয় নিয়ে মহালয়ার পথে রওনা হন শান্তি রানীর স্বামী সরেন্দ্র নাথ বর্ম্মণ।
মন্দির থেকে ফিরে এসে সবাই একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাবেন এমন আয়োজনে যখন শান্তি রানী বাড়িতে ব্যস্ত হয়ে উঠে, ঠিক এমন সময় নৌকা ডুবির দুঃসংবাদ তার কানে আসে। বাড়িতে থাকা দুই ছেলে ছুটে যায় করতোয়ার সেই আউলিয়ার ঘাটে। জানতে পারে পরিবারের সাতজনের মধ্যে একজন বেঁচে গেছে। বাবা, বোন, বোনের জামাই সবাই নদীর জলে ভেসে গেছে। পরিবারের এতগুলো মানুষের নির্মম মৃত্যু বর্ননা দিতে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কান্না করতে থাকে সরেন্দ্র নাথ বর্ম্মণের স্ত্রী শান্তি রানী।
এই আর্তনাত বুঝানো কোনো ভাষা নেই, একই পরিবারের সাতজনের মধ্যে বেঁচে যায় একজন। নিজের দুই মেয়ে দুই জামাই একজন নিকট আত্মীয়ের মরদেহ পেলেও নিখোঁজ স্বামীর শোকে বার বার মূর্ছা যাচ্ছে সরেন্দ্র নাথ বর্ন্মণের স্ত্রী শান্তি রানী। ঘটনার ১৫ দিন পার হয়ে গেল। অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না নিখোঁজ তিনটি পরিবারের স্বজনদের। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় পার করছে প্রতিটি মুহূর্ত। শোক এবং উৎকণ্ঠায় ভোগ বিলাস পূজাপার্বণ সব কিছুই তাদের কাছে এখন ফিকে হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আর্তি যে কোনো ভাবে তাদের স্বজনদের যেন খুঁজে দেয়া হয়।
মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুই মেয়েসহ ছয় স্বজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন সরেন্দ্র নাথ বর্ম্মণ। নৌকায় ভিড় থাকায় সবাই ছিলেন কাছাকাছি। মাঝ নদীতে নৌকা তলিয়ে যাওয়ার পর সাঁতরে তীরে আসেন বিনয় চন্দ্র বর্ম্মণ নামের তাদের এক স্বজন। কিন্তু হারিয়ে জান অন্য ৬ জন। এরপর একে একে দুই মেয়েসহ পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার হলেও সরেন্দ্র নাথের খোঁজ মেলেনি এখনো। স্বজনদের দাহ শ্রাদ্ধ শেষ হলেও স্বামীর জন্যে অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না শান্তি রানীর। মৃত্যুকে মানতে না পেরে হাতের শাখা কপালের সিঁদুর এখনো মুছতে পারেননি তিনি। পরিবারের সবাই বাবাকে খুঁজে পেতে চায়।
অন্য দিকে স্ত্রী রুপালী রানী ও তিন বছরের শিশু দীপুকে নিয়ে নদী পার হচ্ছিলেন ভূপেন্দ্র নাথ বর্ম্মণ। নৌকা ডুবির পর শিশু দীপু উদ্ধার হলেও নদীতে হারিয়ে যায় ভূপেন রুপালী দম্পতি। পরদিন রুপালীর লাশ উদ্ধার হলেও ভূপেন এখনো নিখোঁজ। বৃদ্ধ দাদির কোলে এখন ঠাই শিশু দিপুর। বড় ছেলে দিপন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। পরীক্ষার মাঝে নিখোঁজ বাবার শোক কি ভাবে সামলাবে দিশেহারা সে।
দুই পরিবারের স্বজনদের মতো শোকের সঙ্গে চলছে অপেক্ষার পালা আলেশ্বরীর পরিবারে। ঘটনার দিন দুই মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ির লোকজনের সঙ্গে নদী পার হচ্ছিলেন আলেশ্বরী রাণী। দুই বছরের জ্যোতি রানীকে কোলে রেখে বড় মেয়ে জয়া রানীকে দিয়েছিলেন নানীর কোলে। মাঝ নদীতে নৌকা ডুবে গেলে মা ও নানীর কোল থেকে জ্যোতি ও জয়া পানিতে পড়ে যায়। উদ্ধারকারীদের মাধ্যমে আলেশ্বরী পাড়ে উঠতে পারলেও বাকিরা হারিয়ে যায়। পরে জ্যোতিসহ বাকিদের মরদেহ উদ্ধার হলেও জয়া এখনো নিখোঁজ।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার মাডেয়া ইউনিয়নে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে বিকেল ৩টা দিকে মন্দিরগামী প্রায় দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। মর্মস্পর্শী এই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে ডুবুরি দলসহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অন্যান্য দল চলে গেছে। সীমিত আকারে নিখোঁজ তিনজনের উদ্ধার অভিযানে রয়েছে বোদা ফায়ার সার্ভিস। ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশনা ছাড়া চলবে উদ্ধার অভিযান বলনে পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক শেখ মো. মাহাবুবুল ইসলাম।