প্রকাশ: ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১১:২৮ : পূর্বাহ্ণ
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া আউলিয়া ঘাটে রোববার ট্রলার ডুবির ঘটনায় আজ বুধবার পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো চারজন নিখোঁজ রয়েছে বলে প্রশাসন জানিয়েছে।
নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে করতোয়া নদীর দুই পাড়ে অপেক্ষা করছেন শত শত মানুষ। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এত প্রাণহানির কারণ কী?
কারণ খুঁজতে গিয়ে ডুবে যাওয়া ট্রলার থেকে বেঁচে ফেরা মানুষ, স্থানীয় মানুষ, দমকল, পুলিশ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে প্রথম কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ঘটনার দিন হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রচুর মানুষ এসেছিলেন।
এর কারণ আউলিয়া ঘাটের অপর পাশেই রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বদেশ্বরী মন্দির, এবং এটি সনাতন ধর্মের একটি তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয় মানুষেরা বলছেন, মহালয়া উপলক্ষে প্রতিবছরই বদেশ্বরী মন্দিরে অনেক বড় অনুষ্ঠান হয় এবং আশপাশের জেলাগুলো থেকে সনাতন ধর্মের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ এ অনুষ্ঠানে জমায়েত হন।
তাদের নিরাপত্তার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ, দমকল বাহিনী, আনসার, গ্রাম পুলিশ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের করতোয়া নদীর দুই পাড়ে মোতায়েন করা হয়েছিল।
মানুষের হুড়োহুড়ি ও অসচেতনতা
করতোয়া নদীতে ১২ মাস পানি থাকে এবং এই নদীর ওপর কোনো সেতু নেই। ফলে নদী পারাপারের জন্য নৌকা এবং ট্রলারই ভরসা।
ট্রলার ডুবির ঘটনায় উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া দমকল বাহিনীর কর্মকর্তা শাজাহান আলী রোববার বিবিসিকে বলেছেন, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে তারা নদীর পাড়ে কাজ শুরু করেন।
উৎসবের দিন হওয়ায় সেদিন ঘাটে প্রচুর মানুষের ভিড় ছিল। কিন্তু তাদের সতর্কতার সঙ্গে নদী পারাপারের জন্য দমকল বাহিনীর কর্মীরা মাইকিং করেছিলেন।
আলী বলেছেন, খেয়া পার হতে আসা মানুষজনকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে, এমনকি হ্যান্ডমাইক নিয়েও কিছুক্ষণ পরপর সতর্ক করা হয়েছে, কিন্তু তারা শোনেননি।
‘আমরা বারবার বলছি। মুখে বলছি, মাইকে বলছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা’ বলেন আলী।
কর্মকর্তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, যখন দেখা গেল নিষেধ সত্ত্বেও একসঙ্গে বেশি মানুষ উঠছে, তখন তাদের থামানো যেত কি না। উত্তরে তারা বলেন, ধর্মীয় উৎসব বলে জোর খাটানোর কথা ভাবা হয়নি।
কিন্তু মহালয়ায় হাজারো লোকের সমাগম হবে, তার প্রস্তুতি হিসেবে তাদের পারাপারে ৬টি ট্রলার দেওয়ার আবেদন করা হয়েছিল সনাতন সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। কিন্তু সেদিন বরাদ্দ ছিল ৩টি ট্রলার, মানুষের বাড়তি চাপ ছিল।
যে ট্রলারগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো মাঝারি আকারের বালু বহনকারী নৌযান। একেকটির দৈর্ঘ্য ১৮ থেকে ২০ ফুটের মতো।
এই আকৃতির একটি নৌযানে সেদিন একশ’র বেশি মানুষ উঠে পড়েছিল, স্থানীয়দের কেউ কেউ মনে করেন ট্রলারে দেড়শ’র বেশি মানুষ ছিল।
ওই ট্রলার ডুবি থেকে বেঁচে ফিরেছেন এমন একজন বিবিসিকে বলেছেন, ট্রলারে কোনো মানুষের বসার জায়গা ছিল না, তারা সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
নদীর গভীরতা কম, কিন্তু স্রোত ছিল অনেক
করতোয়া নদীতে ১২ মাস পানি থাকে ঠিকই, কিন্তু নদীটি পঞ্চগড়ের ওই এলাকায় খুব বেশি গভীর নয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঘটনার আগের কয়েকদিন টানা বৃষ্টি হয়েছিল, তার ফলে উজান থেকে পানি নেমে নদীতে পানির প্রবাহ অনেক বেড়েছিল। এটি বেশি হয়েছিল ভারত থেকে বাংলাদেশে পানি ঢোকে যে ঘোড়ামারা পয়েন্টে, সেখানে।
দমকল বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, রোববার সকালেও করতোয়ায় পানি কয়েক ফুটের মতো বেড়েছিল। আর তার সাথে নদীতে ছিল প্রবল স্রোত, স্থানীয়রা বলছেন “নদী ফুলে” উঠেছিল।
হয়ত এ কারণেই ট্রলার ডুবির কয়েক ঘণ্টা পরই পঞ্চগড় থেকে ৬০ কিলোমিটারের মতো দূরে অবস্থিত দিনাজপুরে পাওয়া গেছে কয়েকজন যাত্রীর লাশ।
তবে, দমকল বাহিনীর কর্মীরা বলেছেন, তাদের চোখের সামনেই যখন ট্রলারটি উল্টে যায়, সাথে সাথেই নদীতে নেমে উদ্ধার অভিযান শুরু করেছিল দমকল উদ্ধারকারীরা।
ট্রলারে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি
দুর্ঘটনায় এত প্রাণহানির আরেকটি কারণ হিসেবে স্থানীয়রা মনে করেন, ট্রলারে যাত্রীদের বড় অংশটি ছিলেন নারী ও শিশু। এর ফলে সাঁতরে তীরে উঠতে এবং সন্তানের প্রাণ রক্ষায় অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
উদ্ধার হওয়া মরদেহের মধ্যেও এখনো পর্যন্ত নারীর সংখ্যা বেশি। নিহত ৬৮ জনের মধ্যে ৩০জনই নারী। এছাড়া পুরুষ ১৮ জন এবং শিশু ২০ জন।
এদিকে, রোববার ট্রলার ডুবির দিন মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদের কাছে ৬৬ জন মানুষের নাম নিখোঁজ হিসেবে নিবন্ধন করা হয়েছিল। সেখান থেকে বেশ কয়েকজনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে।
এখনো প্রায় ৩০ জনের মতো মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন