চট্টগ্রাম, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ , ১৫ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অর্থের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি অনিশ্চিত কামরুজ্জামানের

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২২ ১১:৫৪ : পূর্বাহ্ণ

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ- বাল্যকালে পরিবারের আদরেই বেড়ে উঠছিল কামরুজ্জামান। তবে সে আদর বেশীদিন সহ্য হয়নি তার জীবনে। নিজেকে বুঝতে না বুঝতে হানা দেয় প্রবল আঘাত৷ পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় হার্ট অ্যাটাক করেন তার বাবা। তখন থেকে পরিবারে নেমে আসে নানা সংকট৷  অভাব-অনটন যেন নিত্যদিনের চলার সাথী হয়ে রইলো। প্রতিনিয়ত বাবার ঔষধ, সংসারের খরচ ও নিজের পড়াশোনাসহ ত্রিমুখী চাহিদা তাকে আঁকড়ে ধরলো। সবার ভাবনা ছিল হয়তো ইতি ঘটে যাবে পড়াশোনা নামক শব্দটির । তবে স্বপ্নে স্থির ছিল সে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতেই হবে।
নানা প্রতিবন্ধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন কামরুজ্জামান। পড়াশোনায় সহপাঠীদের মত করে সুযোগ সুবিধা না পেলেও ফলাফলে চমক ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে। স্বপ্নে সফলতা হওয়ার যাত্রা হিসেবে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করে এবারে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে।তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও ভর্তি ফি ও আনুষাঙ্গিক খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছে কামরুজ্জামান ও তার পরিবার।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ১১ নং মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাতৃগাঁও মোহাম্মদপুর গ্রামের মোখলেসুর রহমানের ছেলে কামরুজ্জামান। মাতৃগাঁও মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে অর্থের অভাবে ভর্তি যেন অনিশ্চিতের পথে তার৷
কামরুজ্জামান বলেন, প্রাইমারিতে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার আগে আমার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেন৷ পরে চিকিৎসা নেওয়ার কিছুদিন পর সুস্থ হলেও আবার হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি৷ তখন থেকে বাবা আর কিছু করতে পারেননা৷ আমি আর আমার মা সব কাজগুলো করি৷ আমার কাছে পড়াশোনাটা ছিল আকাশচুম্বী স্বপ্নের মত৷ পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া আমার কাছে ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ। অনেক কষ্ট করে অভাব অনটন নিয়ে চালিয়ে গেছি। হাই স্কুলে পড়ার সময় আমার শিক্ষকেরা আমার কাছে কোন ধরনের টাকা নিতেননা৷ বরং বিভিন্ন সময়ে আমাকে তারা বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছেন৷ আমার শিক্ষকেরা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন ও পাশে থেকেছেন৷পরে এসএসসিতে জিপিএ -৫  পাওয়ার পর পড়াশোনায় আমি আরো মনযোগী হয়৷ বাড়ির কাজ অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচ সব দুশ্চিন্তা নিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যায়৷ আবার এইচএসসিতে জিপিএ- ৫ পায় আমি৷ তারপরে ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমি বৃত্তি পায়। তাদের বৃত্তির টাকায় আমি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করি৷ এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় আমি কৃতকার্য হয়৷ আমার ইচ্ছে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হব৷ কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো এখন কেউ বৃত্তি দিবেনা আমি কিভাবে যাতায়াত করব আর ভর্তি হব ও পড়াশোনা চালু রাখব৷ কখনো ভাবি হয়তো থেমে যাবে পড়াশোনা আবার মনে হয় চালাতেই হবে৷ সবমিলিয়ে আমি ও আমার পরিবার দুশ্চিন্তায় আছি। যদি সরকারের পক্ষ থেকে বা সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসে তবেই আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব৷ নতুবা আমার পরিবারের দাড়া সম্ভবনা৷ আর আমি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিসিএস কর্মকর্তা হয়ে আমাদের পরিবারের মত অসহায় মানুষদের পাশে দাড়াতে চায়। আপনারা সকলে আমার পাশে দাড়াবেন ইনশাআল্লাহ।
কামরুজ্জামানে মা কামরুন নাহার বলেন,আমার স্বামী বারো বছর ধরে অসুস্থ। দুইবার হার্ট অ্যাটাক করছে। কোন কাজ কাম করতে পারেননা৷ আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করি। ছেলেকে কখনো খাওয়াতে পারছি কখনো পারিনি৷ অনেক কষ্ট করে আমার ছেলেটা পড়াশোনা করছে। আমি যা আয় করি তা নিজে খেতে আর ঔষধ কিনতে চলে যায়। ছেলেটাকে যে ভালো খাওয়াব আর পড়াব সেটা কখনো পারিনি৷ কষ্ট করে লেখাপড়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাইছে৷ এখন ঢাকা পাঠাব কেমনে আর খরচ জোগাড় করব কিভাবে৷  ভর্তির খরচ কোথায় পাব । আমার হাতে কোন উপায়ও নেই। আপনারা যদি এগিয়ে আসেন তবে আমার ছেলেটা পড়তে পারবে।
 বাবা মোখলেছুর রহমান বলেন, আমি দুইবার হার্ট অ্যাটাক করি৷ আমাকে ডাক্তার ঢাকা যাওয়ার কথা বলেছিল কিন্তু টাকার অভাবে যেতে পারিনি৷ আমি ঔষধ খেতে খেতে একদম শূন্য হয়ে গেছি৷ আমার ছেলেটা খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে।আমার সংসার চলেনা, আমি ঔষধ কিনতে পারিনা কিভাবে এখন তাকে পড়াশোনা খরচ দিব৷ আমি মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। আমাকে বাইপাস করাতে বলেছিল কিন্তু টাকার অভাবে করাতে পারিনি৷ আমি ডাক্তার কে বলেছিলাম আমাকে ঔষধ লিখে দিন৷ পরে ঔষধ খেয়ে এখনো আছি৷ দিন দিন আমার অসুস্থতা বাড়তে থাকে। এখন আবার ডায়বেটিস ধরা পরছে। আমার পায়ে ঘা হয়েছে৷ পায়ের আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে৷ আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার ছেলেটা কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি। আমার ছেলেটাকে আপনারা সাহায্য করুন৷ সে যেন ভালো মানুষের মত মানুষ হতে পারে। আমি তার খরচ চালাতে অক্ষম। আপনারা আমাদের একমাত্র সম্পদের পাশে দাড়ান৷
স্থানীয় প্রতিবেশী হারেছা বেগম বলেন,ছেলেটার মা কোনদিন বাসায় বসে থাকেনা৷ সারাদিন পরিশ্রম করে৷ অন্যের বাড়িতে কাজ করে আবার সংসারের কাজ করে। এখন তার বাবা তো চলতে পারেনা। ছেলেটার পাশে সরকারের দাড়ানো উচিত৷
প্রতিবেশী আকবর আলী বলেন, এদের বসতভিটা ছাড়া আর কোন জায়গা জমি নেই৷ অন্যের জমি চাষ করে সংসার চালাতো। এখন ওর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বিছানায় শুয়ে থাকে। সকলে সাহায্য করে আমরা চিকিৎসার খরচ দিয়েছি৷ এখন সংসার চালাবে না ঔষধ কিনবে নাকি পড়াশোনার খরচ চালাবে৷ খুব কষ্টে আছেন তারা। ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে সকলের এগিয়ে আসা উচিত৷ আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সাবেক ইউপি সদস্য সলেমান আলী বলেন,স্কুল ও কলেজের পড়াশোনায় আমরা তাকে বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছি। তার বাবা একেবারে অক্ষম। তার মা সংসার চালায় আবার অন্যের বাড়িতে কাজ করে৷ এখন কাজের টাকায় পরিবারের টাকা জোগান দিবে, না ছেলের খরচ দিবে৷ এখন তার আর্থিক সহযোগীতা দরকার। সকলে এগিয়ে আসলে এ ফুলটি ঝরে পরবেনা।
মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও গিলাবাড়ী আদর্শ  উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলী বলেন, নিঃসন্দেহে ছেলেটি অনেক মেধাবী। তার বাবা প্রায় এক যুগ ধরে বিছানায়৷ তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। আমরা তাকে সহযোগিতা করেছি মাঝে মধ্যে। সম্প্রতি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে৷ কিন্তু ভর্তি ও আনুষঙ্গিক খরচের জন্য তার পরিবার দুশ্চিন্তায় রয়েছে৷ আমরা চেষ্টা করছি তার পাশে দাড়ানোর।  সরকার ও সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে এ মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সম্পদে রুপান্তরিত করা যাবে৷
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মোঃ শামসুজ্জামান  বলেন,কামরুজ্জামান বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তার পরিবারও বেশ অস্বচ্ছল। তার পড়াশোনা যেন থেমে না যায় সেজন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে।

Print Friendly and PDF