প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর, ২০২৪ ১১:০২ : পূর্বাহ্ণ
চলতি বছরের ইয়াং অ্যাক্টিভিস্ট সামিট ২০২৪ লরিয়েট সম্মাননা জিতে দেশের জন্য অনন্য সম্মান বয়ে আনলেন বাংলাদেশের জলবায়ু কর্মী সোহানুর রহমান। জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে বাংলাদেশের সোহানুর রহমান তৃণমূল পর্যায়ে জলবায়ু সুবিচার, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যুব নেতৃত্ব বিকাশে অসাধারণ ভূমিকার জন্য ইয়ং অ্যাক্টিভিস্ট লরিয়েট অ্যাওয়ার্ড-এ ভূষিত হয়েছেন। “অনেক দূরে যাও, একসাথে যাও” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ১৯ নভেম্বর আয়োজিত এই সম্মেলনে পাঁচজন বৈশ্বিক তরুণ নেতাকে সম্মানিত করা হয়। যেখানে সোহানুর বাংলায় ভাষণ দেয়ার গৌরব অর্জন করেন। ২৭ বছর বয়সি সোহানুর রহমান জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মর্যাদাপূর্ণ এ সম্মাননা অর্জন করেছেন।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের অফিসের হোম প্যালাইস ডেস নেশনসে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানটি সরাসরি ওয়েবকাস্ট করা হয়। অন্যান্য বিজয়ীরা হলেন মার্লে ডায়াস, ১৯, ইউএস (মিডিয়ায় কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিনিধি); শানলি ম্যাকলারেন, ২৫, ফ্রান্স (অনলাইনে জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতা); আলভারো কুইরোজ, ২৫, মেক্সিকো (গৃহহীনদের সাহায্য করা); এবং সিনথিয়া হোউনিউহি, ২৯, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ (জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার)।
সোহানুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস যা এখন ইয়ুথনেট গ্লোবাল নামে পরিচিত। জলবায়ু সুবিচার নিয়ে তৃণমূলে কাজ করছে এমন তরুণদের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস। ২০১৬ সালে বরিশাল শহরে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সংগঠনটি যুব জলবায়ু ঘোষণাপত্র তৈরি করে বর্তমানে দেশের প্রায় ৫০টি জেলায় কয়েক হাজার তরুণ স্বেচ্ছাসেবকের নেতৃত্বে কাজ করছে।
২০১৯ সালে সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিরুদ্ধে প্রথম জলবায়ু আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পর সে ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশে আন্দোলন শুরু করেন ইয়ুথনেটের জলবায়ু কর্মীরা। এখনও চলছে সেই সবুজের আন্দোলন গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক। যে আন্দোলনের উত্তাপ পৌঁছে গেছে দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বের রাজপথেও। স্থানীয় নেতৃত্বের অভিযোজনের উদাহরণ তৈরি করতে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে গড়ে তুলেছে চর ইয়ুথনেট। সম্প্রতি, সোহানুর ও তার দল বাংলাদেশে বৃহত্তর গণতন্ত্রের পক্ষে ছাত্র নেতৃত্বাধীন জুলাই-আগস্ট গণ-আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সোহানুর অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডায় জলবায়ু পদক্ষেপকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছেন।
সোহানুর রহমান তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, এবং পরিবেশগত রূপান্তরের ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদানের জন্য এ সম্মাননা অর্জন করেছেন। বাংলায় ভাষণ প্রদানকালে তিনি তার সাহসী সহকর্মী শ্রাবণসহ জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহিদ ও আহত সমস্ত তরুণ যোদ্ধাদের এবং এই বিশ্বকে আরও ভাল, আরও সুন্দর জায়গা করে তোলার জন্য প্রতিদিন প্রচেষ্টারত সমস্ত অক্লান্ত জলবায়ু যোদ্ধাদের এই পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন।
এর আগে, সোহানুর রহমান আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (কপ২৯) সরকারি যুব প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তার আন্তর্জাতিক বিষয় সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকীর সাথে সাক্ষাৎ করেন, যারা তাঁর জলবায়ু ন্যায়বিচার ও যুব নেতৃত্বাধীন সক্রিয়তার প্রতি তার সমর্থনের প্রশংসা করেছেন।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস, ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল এবং জেনেভায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিশনের মতো সংস্থাগুলো সোহানুরের অনুপ্রেরণামূলক নেতৃত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক অভিনন্দন বার্তায় বলছে, ‘সোহানুর রহমানকে অভিনন্দন! এই অসাধারণ তরুণ বাংলাদেশী জলবায়ু সুবিচার ও মানবাধিকার কর্মী মর্যাদাপূর্ণ ইয়াং অ্যাক্টিভিস্ট সামিটের পাঁচজন বিজয়ীর একজন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইয়াং অ্যাকটিভিস্ট সামিট ২০২৪ লরিয়েট সম্মাননা প্রাপ্তিতে সোহানুর রহমানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছে, ‘বিশ্ব ও বাংলাদেশের সোহানুর রহমানের মতো তরুণ পরিবর্তনকর্মীদের প্রয়োজন।’
ইইউ বলেছে, বাংলাদেশি যুবকদের একটি টেকসই, ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়ার প্রচেষ্টায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সোহানুর তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন, যেখানে তিনি ২০০৭ সালের সুপার সাইক্লোন সিডর থেকে বেঁচে থাকার কথা স্মরণ করেন। সেই ঘটনাই তাকে জলবায়ু সুবিচারের প্রতি আজীবন অঙ্গীকার করতে অনুপ্রাণিত করে। ২০১৬ সালে, তিনি ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করেন, যা সারা দেশে যুবদের একত্রিত করে টেকসই উন্নয়নের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে, সংগঠনটি ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সংসদে জলবায়ু সংকটকে গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য সফলভাবে এডভকেসি করে এবং মাতারবাড়ি-২সহ ১০টি প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করতে ভূমিকা রাখে।
পরিবেশগত সক্রিয়তার পাশাপাশি, সোহানুর গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কার এবং মানবাধিকার সুরক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
সোহান বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই পরিবেশ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয় এবং স্কুলে পড়াশোনার সময় থেকেই তিনি পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রকৃতি সংরক্ষণ ও জলবায়ু সংকট নিয়ে কাজ শুরু করেন। সোহান ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিসের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করছেন। বরিশালের পরিবেশগত দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং ছোটবেলা থেকে পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা তাকে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলেছে। তিনি পরিবেশ রক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, প্লাস্টিকদূষণ কমানো এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও কাজ করছেন।
সোহানুর রহমান তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন। যার মধ্যে অন্যতম ২০১৭ সালে কপ২২ সম্মেলনে গ্লোবাল ওয়াটার পার্টনারশিপ থেকে ইয়ুথ ফর ওয়াটার অ্যান্ড ক্লাইমেট অ্যাওয়ার্ড এবং একশনএইড বাংলাদেশ থেকে নাসরীন স্মৃতিপদক ২০২১। মানবাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য এসব পুরস্কার দেওয়া হয়।