প্রকাশ: ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ৩:৫৫ : অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক: কর্ণফুলী নদীতে নোঙর করা তেলবাহী জাহাজ থেকেই হাজার হাজার লিটার জ্বালানি তেল চুরি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই চুরির সাথে শুধু তেল চোর চক্র সিন্ডিকেট জড়িত নয়। জড়িত জাহাজের মেরিনার মাষ্টার। যাদের কাছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনও (বিপিসি) অসহায়।
সন্ধ্যা হলেই কর্ণফুলী নদীর বুকে নোঙ্গর করা জাহাজে তেল চুরির মহোৎসব শুরু হয়। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। ওইসব চোরাই তেল দোকান হয়ে পাইকারি ও খুচরা গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে যায়। ছোট দোকান, অয়েল ফিলিং স্টেশন, গাড়ির গ্যারেজ, বড় শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন জায়গাতেই ওই তেল যায়।
সম্প্রতি এমন অভিযোগ অনুসন্ধানে তথ্য মিলে, কর্ণফুলী নদীতে বেশির ভাগ তেল চুরি হয় এস আলম কোম্পানীর সাতটি জাহাজ থেকে। জাহাজগুলো হলো-এমটি ইস্টার্ন গ্লোরী-১১৭০, এমটি ইরাবতি-১৫৩০, এমটি ময়ুর-১৪৩০, এমটি এভারগ্রীণ-১৬১০, এমটি সায়মা-১২২০, এমটি ক্যানেল ব্রিজ-১৫৮০ ও এমটি বুলবুল (জলযানের আগে এমটি মানে মোটর ট্যাঙ্কার)।
এসব লাইটারেজ ট্যাঙ্কার জাহাজের রক্ষণাবক্ষণে ‘শীপ ইন্সপেক্টর’ হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন আবছার হোসাইন চৌধুরী ও মোহাম্মদ আবু নামে দুই ব্যক্তি। এরমধ্যে ইস্টার্ন গ্লোরী জাহাজের মাষ্টার মোঃ ছিদ্দিক, ইরাবতি জাহাজের মাষ্টার এমএ রহমান, ময়ুর জাহাজের মাষ্টার প্রতাপ, এভারগ্রীণ জাহাজের মাষ্টার আশরাফুল, সাইমা জাহাজের মাষ্টার রাজন, ক্যানেল ব্রিজ জাহাজের মাষ্টার নুর উদ্দিন ও বুলবুল জাহাজের মাষ্টার হাবিব চোরাই কারবারে জড়িত বলে অনেকের অভিযোগ উঠেছে।
কিভাবে এরা জাহাজ থেকে তেল চুরির কাজটি করে থাকেন এমন অনুসন্ধানে নির্ভরযোগ্য সূত্রে বলছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত তেল প্রথমে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। সেখান থেকে ছোট জাহাজ যোগে ঢাকা ও খুলনায় বিতরণ কোম্পানির ডিপোতে সরবরাহ করে বিপিসি।
চট্টগ্রাম থেকে যে পরিমাণ তেল জাহাজে ভরা (লোড) হয়, একই পরিমাণ তেল জাহাজগুলোকে গন্তব্য ডিপোতে খালাস (আনলোড) করতে হয়। কিন্তু জাহাজের মাষ্টার ও লোকজনের যোগসাজেসই নিয়মিত তেল চুরি হচ্ছে। আর এই চুরি করা তেল অল্প দামে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও হাতিয়ার কালোবাজারিদের কাছে বিক্রি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নদীপাড়ের ক্ষুদ্র তেল ব্যবসায়িরা জানান, এস আলম কোম্পানীর জাহাজ মাদার ভেসেল ট্যাঙ্কার থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে প্রথমে কর্ণফুলীতে নদীতে পৌঁছান। এর পরে কোস্টগার্ড সংলগ্ন জেটি থেকে নতুনব্রিজের পাশে কোম্পানীর নিজস্ব জেটিতে তেল আনলোড করেন। সেখানে পুরো তেল আনলোড করার পরও প্রতিটি জাহাজে কৌশল অবলম্বনে গোপন টাঙ্কিতে ১৮ থেকে ২০ ড্রাম তেল রেখে দেন।
পরে আনলোড করা জাহাজটি কর্ণফুলী নদীর যেকোন বয়াতে নোঙ্গর করেন। ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে অন্য জাহাজের মাষ্টারেরা তাদের জাহাজেও রাখা চোরাই তেলগুলো বয়াতে থাকা জাহাজে পাঠিয়ে দেন। যেমন-বয়াতে বাঁধা রয়েছে এমটি ইরাবতি জাহাজ। তখন অন্য জাহাজগুলো অর্থ্যাৎ এমটি ইস্টার্ন গ্লোরী, ময়ুর, এভারগ্রীণ, সায়মা, ক্যানেল ব্রিজ ও বুলবুল জাহাজে থাকা সব চোরাই তেল এসে পৌঁছাবে ইরাবতিতে।
পরে এসব তেল রাতের আঁধারে পতেঙ্গায় চরপাড়া, অন্যতায় সুযোগ বুঝে নোয়াখালীর হাতিয়ায় পাঠিয়ে দেন। এসব কিছুই ঘটে রাতের আঁধারে। জাহাজ মালিকের অগোচরে। মূলত এ কাজে জাহাজের মাষ্টারই সিদ্ধহস্ত বলে অনেকেই জানান। যদিও তাঁরা সবৈর্ব অস্বীকার করেন। আরো জানা যায়, হাতিয়ার সবচেয়ে বড় চোরাই তেল ক্রয়কারী ব্যক্তি হলেন মোঃ বেলাল সওদাগর। যার কাছে পৌঁছে বিভিন্ন কোম্পানির চোরাই তেল।
এভাবেই লুট হচ্ছে রাতের আঁধারে হাজার হাজার লিটার তেল। প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কিছুদিন আগেও নৌ-পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এমটি বুলবুল জাহাজের ১৮ ড্রাম চোরাই তেল। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় এক লক্ষ ৮ হাজার টাকা।
অনেক সময় আবার জাহাজের শ্রমিকরা কুলে উঠানামা করতে সাম্পান মাঝিদের শরনাপন্ন হন। মাঝিরা সারাদিন জাহাজের লোকদের আনা নেওয়া করেন। বিনিময়ে মাঝিদের টাকার বদলে দিয়ে থাকেন ৩ থেকে ৪ কন্টিন তেল। এক কন্টিনে ২০-২৫ লিটার। স্বয়ং জাহাজের লোকজন চোরাকারবারে জড়িত থাকায় চুরিতে কুল কিনারা পাচ্ছে না জাহাজ কতৃপক্ষ। কারণ রক্ষণ যখন ভক্ষক হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে, তখন জাহাজ মালিকও বিপিসির মতো নিরুপায়। জানা যায়, এ কান্ডে বিপিসি শুধু লোকসান গুনে।
একই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইরাবতি জাহাজের মাষ্টার এম এ রহমানকে ফোন করে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে মাষ্টার রহমান বলছেন স্বীকার করে কুশল বিনিময় করেন। পরে যখনই সাংবাদিক পরিচয় জানতে পারলেন হঠাৎ বেঁকে বসেন, তথ্য দিতে অস্বীকার করে বলেন তিনি রহমান নয়।
এস আলম জাহাজের রক্ষণাবক্ষণ শীপ ইন্সপেক্ট আবছার হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু এখন বলতে পারব না। আমি এখন মিটিংয়ে আছি। পরে কল দিতে পারেন।’ ৩০ মিনিট পর পূনরায় কল দিলে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
নৌ-পুলিশের সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবিএম মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরাও খবর পেয়েছি চোরচক্রের সদস্যরা পরস্পর যোগসাজশে লাইটারেজ জাহাজ থেকে তেল পাচার করে থাকেন। তারপর সেগুলো ঘাটে এনে ভাউজারে খালাস করে। খালাসের সময় কয়েকদিন আগেও ১২ জনকে আটক করেছি। এর মধ্যে সাত জন শ্রমিক ও পাঁচ জন জাহাজের কর্মী। তাদের বিরুদ্ধে পতেঙ্গা থানায় মামলা হয়েছে। কারণ তেল খালাসের সময় সংশ্লিষ্টরা কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। নদী পথে তেল চুরি বন্ধে নৌ পুলিশের অভিযান সব সময় সতর্ক রয়েছে। নদীতে নিয়মিত টহল টিম জোরদার করা হয়েছে।’